নিজস্ব প্রতিবেদক, খাগড়াছড়ি :
খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার রসিকনগর এলাকার ৪টি গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে ৮ লাখ টাকা। বাকি রয়েছে আরও প্রায় ৩ লাখ টাকা। বকেয়া টাকা পরিশোধ না করায় দুটি লাইনে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না এবং অপর দুটি এলাকায় বৈদ্যুতিক খুঁটি পাইলিং বন্ধ রাখার অভিযোগ উঠেছে একটি দালালচক্রের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনে মৌখিক অভিযোগ করেছে এলাকাবাসী। তবে বিষয়টির কোনো সুরাহা হয়নি এখনো। স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে এ অনিয়ম ও দুর্নীতি করছে একটি চক্র।
গত শনিবার (২৫ জুলাই) অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সরেজমিনে গেলে এলাকাবাসী জানান, রসিকনগরের ৪টি গ্রামে (রসিকনগর বটতলা বাজার, উত্তর রসিকনগর, রসিকনগর গুলছড়ি ও রসিকনগর সিলেটি পাড়া) বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য গ্রামবাসীর কাছ থেকে পরিবার প্রতি বৈদ্যুতিক খুঁটি বাবদ ৫-৮ হাজার টাকা লাগবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। এ টাকা উত্তোলনে এলাকায় কমিটিও করা হয়। কমিটির মাধ্যমে এলাকাবাসীর কাছ থেকে প্রায় ৮ লক্ষ টাকা চাঁদা উত্তোলন করে হাতিয়ে নেয় অভিযুক্ত মিজানসহ স্থানীয় চক্রটি। এলাকাবাসী আরো জানান, রসিকনগর বটতলা বাজার এলাকা থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার, উত্তর রসিকনগর এলাকা থেকে ২ লাখ, রসিকনগর গুলছড়ি হিন্দুপাড়া থেকে ৩ লাখ, রসিকনগর সিলেটি পাড়া থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে। এছাড়াও এখনো আরও ৩ লাখ টাকার মতো বাকি রয়েছে। যে টাকার জন্য বৈদ্যুতিক খুঁটি গাড়ার কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।
রসিকনগর গুলছড়ির বাসিন্দা দিনমজুর মনিরুল বলেন, ‘আমি দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ। কাম-কাজ করে আমার সংসার চলে। বিদ্যুতের টাকা উত্তোলনের জন্য গঠিত কমিটির সদস্য জালালের নিকট ৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে আমাকে। তা না হলে এলাকায় বিদ্যুৎ আসলে আমি বিদ্যুৎ পাব না। করোনা মহামারিতে আমি এমনিতে খুব কষ্টে আছি। আমার টাকা ফেরত পেলে খুব উপকার হতো’
রসিকনগর সিলেটি পাড়া এলাকার মনসুর আলম বলেন, আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ দেবার কথা বলে দালাল মিজান ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা দাবি করেছে। আমরা আমাদের এলাকার আমিনুলের মাধ্যমে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা দিয়েছি। বাকি টাকা দিলে বিদ্যুৎ সংযোগ দেবে বলে জানায়। অপরদিকে গুলছড়ি হিন্দুপাড়া এলাকা থেকে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা নিয়েছে তারা। এখন কাজ বন্ধ রেখেছে। আমরা টাকা ফেরত চাই এবং দ্রুত অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার দাবি জানাই। পাশাপাশি এদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
দীঘিনালা উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, রসিকনগর বাজার এলাকার বাসিন্দা মাহমুদা বেগম লাকী বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হবে। অথচ সেখানে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালালচক্র। এ এলাকার অধিকাংশ মানুষই গরিব। তারা দিন আনে দিন খায়। আমার এলাকা থেকে নতুন বৈদ্যুতিক খুঁটি ও ট্রান্সফরমার বসিয়ে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করার কথা বলে শফিকের মাধ্যমে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়েছে মিজান। কিন্তু সে এখন বিদ্যুতের লাইন দিচ্ছে না। দ্রুত বিদ্যুৎলাইন চালু করে ভুক্তভোগীদের টাকা ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি মিজানসহ এ চক্রের সকলের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
এদিকে বৈদ্যুতিক লাইন নিয়ে সাংবাদিকের কাছে টাকা উত্তোলনের তথ্য প্রকাশ করায় এলাকাবাসীকে বিদ্যুতের কাজ বন্ধ করে দেবার হুমকি দিয়েছে দালালচক্রটি। পাশাপাশি বকেয়া টাকা দ্রুত পরিশোধ করতেও বলেছে তারা। এ নিয়ে রসিকনগর এলাকায় উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ বন্ধ হওয়া নিয়ে আতংকে রয়েছে সাধারণ মানুষ। তাই দ্রুত এসব দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তির দাবি এলাকাবাসীর।
এ ব্যাপারে মিজানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এখানে মূলত উত্তর রসিকনগর এলাকার শফিকুল, সিলেটি পাড়ার আমিনুল, বাজার এলাকার সোবহান, এবং গুলছড়ি হিন্দুপাড়া এলাকার অমল কৃষ্ণ (খলিফা) টাকা উত্তোলন করেছে। আমি শুধু আমার খরচের টাকা নিয়েছি। এর বাইরে আমি কোনো টাকা নিইনি। এ ব্যাপারে আমি আর কিছুই জানি না। আপনি গ্রামের কমিটির সাথে কথা বলেন।
কমিটির সদস্য আমিনুল ইসলাম বলেন, মিজানের সাথে আমাদের ১০ লক্ষ টাকার চুক্তি হয়েছিল। আমরা তাকে অনেক টাকা দিয়েছি। এখনো কিছু টাকা বাকি আছে। যার জন্য এখানে বিদ্যুতের কাজ বন্ধ রয়েছে। আমি আপনার সাথে সাক্ষাতে কথা বলব।
অভিযুক্ত বটতলী গুলছড়ি হিন্দুপাড়া এলাকার অমল কৃষ্ণ (খলিফা) বলেন, আমাকে কেউ টাকা দেয়নি। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আপনি আমিনুলের সাথে কথা বলেন। আপনাকে কে বলেছে, তাদের নাম বলেন। এ অভিযোগের বাদী কে, এদেরকে আমার দরকার বলে লাইন কেটে দেন তিনি।
এ বিষয়ে অপর অভিযুক্ত উত্তর রসিকনগর এলাকার শফিকুল বলেন, টাকা নেয়ার বিষয়টি সত্য। তবে এখানে অন্য একটি বিষয় আছে। আমি আপনাকে ফোনে বলতে চাই না। পরে ফোন দিয়ে কথা বলব বলে লাইন কেটে দেন তিনি।
দীঘিনালা বিদ্যুৎ বিভাগের আবাসিক প্রকৌশলী মো. সিরাজ বলেন, মিজানের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ পেয়েছি। সে আমাদের বিদ্যুৎ অফিসের কেউ না। তিনি রাঙামাটি এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রজেক্টের ঠিকাদারদের হয়ে মিস্ত্রী হিসেবে কাজ করেন বলে জেনেছি। এ চক্রটির কারণে আমাদের বিদ্যুৎ অফিসের মান ক্ষুণœ হচ্ছে। তার এবং তার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। এজন্য আমরা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, এ বিষয়ে মৌখিক একটি অভিযোগ পেয়েছি। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার নাম মিজান। এই মিজানের নামে এর আগেও দুদকের কাছে অভিযোগ উঠেছিল। তার এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দীঘিনালা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আলহাজ মো. কাশেম বলেন, বিদ্যুতের জন্য টাকা নেবার একটি অভিযোগ শুনেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেখানে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছেন, সেখানে বিদ্যুতের জন্য টাকা উত্তোলন করা খুবই অন্যায় এবং জঘন্য একটি কাজ। অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা এসব দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।