প্রণব মজুমদার
বেদনার জলে তাঁর হৃদয় সমুদ্র হয়ে গিয়েছিল। একাকিত্বের এই হতাশা দীর্ঘকালের। শোকতাপে বিবর্ণ কবি। বেদনায় নীল! সৃজনে তা প্রকাশ পেয়েছে বারবার। কাব্যকথায় যেমন তিনি উচ্চারণ করেছেন, তেমনি ব্যক্তিগত সখ্যতা যাঁদের সঙ্গে ছিল তাঁদের কাউকে-কাউকে বলেছিলেনও তা। আমি তাদের একজন। বেদনাক্রান্ত একজন বলেই কিনা জানি না, অন্তর্মুখী চরিত্রের বোহেমিয়ান কবি ত্রিদিব দস্তিদার আমাকে সেকথা জানিয়েছিলেন কিছুটা! সেটা সম্ভব হয়েছিল অজানা হৃদয়ঘটিত ব্যাপারের সুখদুঃখগুলো ভাগ করে নেয়ায় আমার প্রবল আগ্রহ দেখে।
‘কোন প্রাণ একা বাঁচতে পারে না বেশি সময়। প্রলম্বিত জীবনে মমতা ও ভালোবাসা খুব প্রয়োজন। গৃহসুখ লাগে।’ কবির গৃহপালিত কষ্টের এমন স্থায়ী যন্ত্রণা প্রকাশ পেয়েছিল আমাদের কথোপকথনে সেদিন। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের লুকায়িত ইতিহাস কেউ জানতে পারেনি। আমি কিছুটা জেনেছি, তাও কবির অন্তরঙ্গ এক বান্ধবীর কাছ থেকে, তিনি আমার আত্মীয়া হওয়ার সুবাদে।
১৯৫২ সালের ৩১ ডিসেম্বর কবির মর্তলোকে আগমন আর প্রস্থান ২৫ নভেম্বর ২০০৪-এ। জন্ম-মৃত্যুর মাঝখানে ৫২ বছর পৃথিবীতে কবির চারণ। ভূষণে আধুনিক ও রঙিন শ্মশ্রুম-িত মানুষটিকে ১৯৮২ সাল থেকে ২১ বছরই দেখেছি প্রাণবন্ত টগবগে যুবক হিসেবে। ভেতরের কষ্টের সমুদ্র যতই প্রগাঢ় হোক না কেন তা সাধারণত প্রকাশ পেত না। সেগুনবাগিচায় কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় মুক্তিযুদ্ধের দলিল প্রকল্পের অফিস, বেসরকারি বৃহৎ বিমা প্রতিষ্ঠান বিজিআইসি, অভয় দাশ লেনের ভোলা নন্দগিরি আশ্রম, শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেট, আমরা সূর্যমুখী বা বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের কবিতাপাঠের আসরে তিনি ছিলেন সবসময় উচ্ছল এক সৌম্য, দীপ্ত পুরুষ। বেদনার লোনাজলের সমুদ্রে ডুবেছিলেন আকণ্ঠ কবি, তা অনুভব করেছিলাম ২০০৪ সালের নভেম্বরে। সমুদ্রনগরী কক্সবাজারের অদূরে চট্টগ্রাম পটিয়ার ধলঘাটে তাঁর বাড়ি হলেও ত্রিদিব দস্তিদার কখনও সেখানে যাননি। দেহাবসানের ক’দিন আগে অর্থাৎ সে বছরের মধ্য নভেম্বরে কক্সবাজারের সমুদ্র¯œাানের মধ্য দিয়ে জীবনের প্রথম ও শেষ ইচ্ছাপূরণ করেন কবি। দুই রাতের কক্সবাজার সফর। সফরসঙ্গী বন্ধু কবি তুষার দাশ, ব্রাত্য রাইসু ও সিদ্ধার্থ হক। ১৬ নভেম্বর যাওয়া, ১৮ তারিখ ঢাকায় ফিরে আসা। ফিরে এসে কবি বলেছিলেন, ‘সমুদ্রে জীবনের সব পাপ ধুয়ে এলাম।’ ঢাকায় ফিরে কবি রচনা করেন দর্শন আশ্রিত কিছু কষ্টের সৃজন। যে কাব্যশিল্পে হতাশার অন্তর্নিহিত দুঃখ বিদ্যমান ছিল। কবি ত্রিদিব দস্তিদারের সর্বশেষ সে কবিতাটির শিরোনাম হলো ‘সমুদ্রের ডি-হাইড্রেশন’। শব্দগুচ্ছ ছিল এমন :
ভাটা সমুদ্রের ডি-হাইড্রেশন
সমুদ্র মানুষকে টানে ডি-হাইড্রেশনে
তবে ফিরিয়ে দেয় তার আকার এবং পরিমাপ
আমরা চার বন্ধু তুষার, সিদ্ধার্থ ও রাইসু
আর আমি
জলের সান্নিধ্যে আছি বেশ কিছুদিন
গলাধঃকরণেও নোনা ঢেউ
হয়ে ওঠে আজ স্কটল্যান্ডীয় সোনালি শিশির
সৈকতের বালিয়াড়ি উষ্ণতায়
ফিরে পাই যেন পরস্পরের কাব্যভাবনার ঋণ
বাংলা কবিতার ডি-হাইড্রেশন
এ যদি হয় আমাদের বাংলা কবিতার ধারা বর্ণনার কক্সবাজার
তবে বড়ো অহংকারী মনে হয় এসব উপাদান
উপাদান আশ্রয়ী উপকরণ খোঁজার পালা
হাফপ্যান্ট পরে কবিতার জোয়ারের
দিকে ছুটে যাওয়া
শব্দ ও টেউয়ের সঙ্গে লড়াই করা,
সাঁতার কাটা
সমুদ্রগর্জনে ভয় পেয়ে কূলে ওঠার
চেষ্টা করা
তবে আমাদের প্রবীণ সাহিত্য-সাঁতারুরা
নিজেকে সমুদ্র-রচনার পারদর্শী
ভাবতে ভাবতে
কবে যে কূলে উঠে গিয়েছিল
ওরা আমরা ভাবিনি।
তাই শিল্পের ডি-হাইড্রেশন
আর সমুদ্রের ডি-হাইড্রেশন আজ
আমাদের সৈকতের ক’টা দিনে আজ এক হয়ে গেল।
(রচনাকাল : ২২ নভেম্বর ২০০৪)
বিরহে বেশ কাতর কবি। একই দিনে রচিত তাঁর কবিতায় সে বোধ এখনও জাগ্রত। কবির হৃদয়ে একাকিত্বের ছাপ, সে শব্দমালায় স্পষ্ট! যা ছিল অপ্রকাশিত। কবি ত্রিদিব দস্তিদার সে সৃজনের নামকরণ করেছিলেন নিঃসঙ্গতার গুণন। কবি বলেন :
একা থাকতে থাকতে
এক-এর অঙ্কে আছি
এক-একে এক
আর কোন গুণন সংখ্যাই
এখন বাড়ে না
বাড়ে শুধু নিঃসঙ্গতার গুণন
একাই নিজের পৃথিবীকে ভাবি
এক ঈশ^র
একটাই কবিতার লাইন
‘নিঃসঙ্গতার গুণনে আমি’
এবং জীবন।
১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে প্রথম দর্শনে যে কবিতাটি শুনে কবির প্রতি আমার ভালোবাসা তৈরি হয়, সেখানেও বিরহের রূপ ও দর্শন দেখতে পাই। আমার সে প্রিয় কবিতাটি হলো :
বাটখারা পড়ে গেলে চ্যাপ্টা হয়
ওজন কমে না
বাটখারা পড়ে গেলে লম্বা হয়
ওজন বাড়ে না
মানুষ পড়ে গেলে হাতল খোঁজে
মানুষ বাড়ে না
মানুষ পড়ে গেলে স্বপ্ন খোঁজে
ভ্রান্তি কমে না!’
তাঁরও স্বরচিত প্রিয় কবিতা এটি। কবিতাপাঠের আসরে বেশির ভাগ সময় তিনি তা আবৃত্তি করতেন নাটকীয় ভঙ্গিমায় দরাজ কণ্ঠে। বাংলাদেশ টেলিভিশনেও তা শুনেছিলাম। পরে দেখা হলে কবিতাটি পাঠের জন্য অনুরোধ করতাম। তিনি সহাস্যে ছন্দোবদ্ধ করে আওড়াতেন :
মানুষ পড়ে গেলে স্বপ্ন খোঁজে
ভ্রান্তি কমে না!’
বহুদিন পর এক বিকেলে আজিজ সুপার মার্কেটে চায়ের আড্ডায় কবিতাটির শেষ চার পঙক্তির মর্মার্থ জানতে চাই। বাংলা থ্রি ফাইভ সিগারেটে শেষটান দিয়ে বললেন, ‘আবিষ্কার করুন। তবে বিরহ আছে।’
কার বিরহ ত্রিদিব দা?
বলবো না।
পরে জেনেছি সাহিত্য সংগঠন কবিতালাপ-এর সংগঠক মনু ইসলামসহ ক’জনের কাছে। ১৯৭৬ সাল। ঢাকায় বসবাসের উদ্দেশ্যে আসার আগে মুক্তিযোদ্ধা কবি চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় থাকতেন। সেখানে পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত জার্মান তরুণী মেরি অ্যান রিক্সকে পড়াতেন। মেরির সঙ্গে প্রেম হয় কবির। গভীর প্রেম গড়ায় পরিণয়ের দিকে। কবির অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং চট্টগ্রামের ‘সাপ্তাহিক স্ব^দেশী’ পত্রিকার সম্পাদক জহির কাজীর সহযোগিতায় রাউজানের গহিরায় ত্রিদিব ও মেরি অ্যানের বিয়ে হয়। তারা সেখানে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে কিছুদিন বসবাস করেন। মেরি অ্যানের বাবা সুকৌশলে তাদের পাথরঘাটায় ফিরিয়ে আনেন। জামাতা হিসেবে ত্রিদিবকে গ্রহণও করেন। কিন্তু কবি শ^শুরের কূটচাল বুঝতে পারেননি। মেরি অ্যানের ভাই দু’জনকে ব্যাপক মারধর করে আলাদা করে ফেলে। বন্ধু জহিরের ভাষায়, ‘ত্রিদিব মেরি অ্যানকে খুব ভালোবাসতো। পিতা রডরিক্স মেয়েকে নিয়ে জার্মানি চলে যান। ত্রিদিবকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার আশ^াস দিয়ে যান। কবি আশায় ছিলেন। নিয়মিতপত্র যোগাযোগও ছিল। কিন্তু আশায় গুড়েবালি! এক সময় বন্ধ হয়ে যায় সে যোগাযোগও। ‘বাটখারা পড়ে গেলে’ কবিতায় বিমূর্ত বিরহ কি তাহলে মেরি অ্যানের জন্য? মেরি অ্যানকে ঘিরে ত্রিদিব দস্তিদারের একটি চিঠি প্রকাশ হয় কবি আবু হাসান শাহরিয়ার ও মনিরা কায়েস সম্পাদিত গতি প্রকাশিত কবিদের প্রেমপত্র পকেট বইয়ে। মেরি অ্যানকে না পাওয়ার হতাশায় অবশেষে চট্টগ্রাম ছাড়েন কবি ত্রিদিব দস্তিদার। ঢাকায় এসে মনোযোগী হন কাব্যের বিরহ ও প্রেম উপাদানে। বেশির ভাগ রচনায় সে বিষয় পরিলক্ষিত হয়। মাত্র ৬টি কাব্যগ্রন্থ তাঁর। ‘গৃহপালিত পদ্যেরা’, ‘অঙ্গে আমার বহুবর্ণের দাগ’, ‘ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে দেবো’, ‘আদি অন্তে তোমাকে চাই’, ‘ভালোবাসার শাদাছড়ি’ এবং ‘পোড়াবো তাজমহল’। বইগুলোতে ত্রিদিবের প্রেম ও বিরহ-দ্রোহ মূর্তমান।
ভালোবাসা নিয়ে বুভুক্ষু কবি প্রেমের অনেক উজ্জ্বল পঙক্তি রচনা করেছেন। মেরি অ্যানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের বাকি ৩০ বছর কবি সংসারসঙ্গী ছাড়া ছিলেন। একাকিত্ব তাঁকে পেয়ে বসেছিল। চল্লিশোর্ধ বয়সে তিনি সংসারী হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। টাঙ্গাইল মির্জাপুরের বন্ধু বিপ্লব বোস তাঁর জন্য প্রায় সমবয়সী পাত্রী ঠিক করেছিলেনও। ভারতেশ^রী হোমসের শিক্ষক ¯িœগ্ধা করের সঙ্গে বেশ কিছুদিন যোগাযোগও ছিল তাঁর। ¯িœগ্ধা পথ চেয়ে কবির অপেক্ষায় ছিলেন অনেকটা সময়। কিন্তু কবির খবর নেই! বোহেমিয়ান জীবন যেন আবদ্ধ সংসারের চেয়ে উত্তম! এমনটা ভেবেই কবি আর জড়াননি সংসার যাপনে। হয়তো বেলা শেষে যৌবনে মেরি অ্যানের ভালোবাসার সৌরভ ক্ষুণœ হবে বলে! কবিতার শব্দগুচ্ছে তিনি তা প্রকাশ করলেন ঠিক এভাবে :
সবাই যেদিকে যায়
আমি যাই না সেদিকে
যেতে যেতে রাস্তার চিহ্ন
এঁকে যায় মানুষ, সেসব ধূসর বড়ো
আমি ওসব রাস্তার নই
আমি যাই সবুজ সড়কে, ভিন্ন মোড়কে।
যে সড়কে তুমি আছো, শুধু তুমি
ভিন্ন এক রূপে, অমৃত স্বপ্নে
সেখানে দাঁড়িয়ে যাই আমি
ভিক্ষাপাত্র হাতে সজল ভিখারী যেন
যে পাত্রে তোমার আলোর ছটা
তৃষ্ণার জল হয় অকাল বুদ্বুদ
যার রঙ সাতরঙে, তৃষ্ণা পুরে না
তবু আমি সেই পথে যাবো
তোমাকে পাবো না শব্দ কিংবা অক্ষরে
বা অন্য কোন সড়ক-পঙক্তিতে
যেখানে তোমার রক্তমাংস খেলা করে
পাওয়া না-পাওয়ার রক্ত মাংসে।