অনির্বাণ ভট্টাচার্য্য »
আষাঢ়ের সন্ধ্যায় তিলোত্তমা সেনগুপ্তার নৃত্য যেন ধ্রুপদী বৃষ্টির ছন্দ-অন্তর্মুখী, অথচ প্রবল উজ্জ্বলতায় দীপ্ত। ১৮ জুলাই ২০২৫ ফেইম স্কুল অব ডান্স, ড্রামা অ্যান্ড মিউজিক-এর ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সন্ধ্যায় আয়োজিত ‘কত্থক সন্ধ্যা’ অনুষ্ঠান তাঁর শিল্পীসত্তার এক জাজ্বল্যমান পরিস্ফুটন। তিলোত্তমার নৃত্যপ্রদর্শন যেন শ্রুতিমধুর কোনো শ্লোক, যা দেহের অঙ্গভঙ্গিমায় প্রতিধ্বনিত হলো তাল ও লয়ের পরম্পরায় যা তিনি ও তাঁর শিষ্যরা সেই সন্ধ্যায় শুরু করেছিলেন কৃষ্ণ বন্দনার মধ্য দিয়ে। ওহফরধহ ঈড়ঁহপরষ ভড়ৎ ঈঁষঃঁৎধষ জবষধঃরড়হং (ওঈঈজ)-এর বৃত্তিপ্রাপ্ত তিলোত্তমা কত্থক কেন্দ্রে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেকে পরিশীলিত করেছেন গুরু ভাশ্বতী মিশ্রা জী, কিষণ মোহন মিশ্রাজী এবং সর্বোপরি কিংবদন্তি পণ্ডিত বিরজু মহারাজজীর সান্নিধ্যে। এই পরম্পরা তাঁর প্রতিটি চরণে ও অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সন্ধ্যার সূচনায় ধামার পরিবেশনায় তিনি যেভাবে ঝঙ্কারে রাগ ও রসের বুনন ঘটালেন, তা যেন এক অন্তরঙ্গ উপাখ্যানের সূচনা। ঠাট ও আমদ্-এ তাঁর গতি ও স্থিতির অপূর্ব সাম্য, পরণামদ-এ প্রতিটি পর্ব ছিল সুসংহত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ। তিনতাল ও তেহাই টুকরা পরিবেশনায় তাল, গতি, চলন ও সম্ -এ ফিরে আসার দৃঢ়তা যেন এক নিখুঁত সৌকর্য হয়ে উঠেছিল। গতনিকাস ও গৎভাও অংশে তাঁর অভিব্যক্তি কখনো মাতৃস্নেহ, কখনো চপল বালকৃষ্ণের প্রলাপ-এই দ্বন্দ্বকে ভাসিয়ে তোলে, দর্শকের হৃদয়ে রেখে যায় একটি অনুরণন।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঠুমরি ও দাদরার পরিবেশনা, যেখানে তাঁর মুখাভিনয় ও দেহভাষা হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে। একই সাথে ঠুমরি পরিবেশনের আগে তিনি নিজ কন্ঠে গেয়ে সঙ্গীতগুরু পিতার পরম্পরা যে তার ধমনিতেও বহমান তার স্বাক্ষর রাখলেন। যদিও একের পর এক নাচের পরে গেয়ে ওঠায় হয়ত গলায় একটু খামতি ছিল কিন্তু তিলোত্তমা যা বোঝাতে চেয়েছেন দর্শকদের তাল, লয়, ছন্দ এবং ঠুমরির সাথে পরিবেশনা, তা ছিল অনন্য। ভাবনৃত্যের মাধ্যমে কৃষ্ণ ও যশোদার সম্পর্কের রসায়ন তুলে ধরার সময় তিনি যেন চরিত্রদ্বয়ে রূপান্তরিত হন মুহূর্তে ননী লোলুপ বালক কৃষ্ণ, আবার মুহূর্তেই মাতৃধর্মে উদ্বুদ্ধ যশোদা।
শেষাংশে যুগলবন্দী পরিবেশনায় তাল ও লয়ের তাৎক্ষণিক সাওয়াল-জবাব খেলার মধ্য দিয়ে তিনি যে অর্ন্তজাগতিক সংলাপ তৈরি করলেন সহশিল্পীর সঙ্গে, তা ছিল শ্রুতিনন্দন এবং মাধুর্যেভরা। এক্ষেত্রে অনবদ্য সঙ্গত করেছেন তাল বাদ্যে সৌমেনজিৎ চক্রবর্তী আর বাঁশিতে ক্যউপ্রু মার্মা। সাথে ছিলেন হারমোনিয়ামে উৎপল শীল, কী-বোর্ডে রিপন শীল। তবে গতি ও ছন্দের পরিপূর্ণ একাত্মতা কোথাও কোথাও কিছুটা বিচ্ছিন্ন মনে হয়েছে। এ সন্ধ্যায় তাঁর সাথে সহযোগী নৃত্যশিল্পী ছিলেন সাজেদা আক্তার সাজু, ভার্ণিকা অন্বেষা দাশ, অনির্ভা সেনগুপ্ত, দীপা নন্দী, দীপান্বিতা দাশ।
সব মিলিয়ে, তিলোত্তমা সেনগুপ্তার এই সন্ধ্যা ছিল এক শাস্ত্রনিষ্ঠ ও ভাবসমৃদ্ধ নৃত্যযাত্রা। তাঁর কঠোর অনুশীলন, গুরুপ্রাপ্ত দীক্ষা এবং গভীর অনুভব মিলে গড়ে তুলেছে এক পরিণত শিল্পভাষা যা ভবিষ্যতে আরও নিটোল, আরও বহুমাত্রিক হয়ে উঠবে এই প্রত্যাশা।