ডেস্ক রিপোর্ট »
আফগানিস্তানের পালাবদলে দুই প্রতিবেশি চীন ও ভারতের ভাবনা এখন একেবারেই বিপরীতমুখী। একদেশের কপালে চিন্তার ভাঁজ। আরেক দেশে উৎফুল্লভাব সুস্পষ্ট। দুই দেশের নীতিনির্ধারকরা লাভ আর ক্ষতির হিসেব কষতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
চীনের লক্ষ্য বাণিজ্যের বিস্তার
২৫ বছরে ভোল বদল হয়েছে চীনের। ১৯৯৬ সালে যখন তালেবান আফগানিস্তান দখল করেছিল তখন তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি চীন। অথচ রবিবার দ্বিতীয় বারের জন্য আফগানিস্তানে তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে সবার আগে সেই সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে তারা। কেন এই অবস্থান বদল চীনের।
কারণ হিসাবে উঠে আসছে তিনটি বিষয়। ১৯৯৬ সালে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলির মধ্যে চীনের নাম ছিল না। সেই সময় তারা নিজেদের দেশের অর্থনীতি নিয়েই ব্যস্ত ছিল। ধীরে ধীরে আমেরিকার পরে বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিধর দেশ হিসাবে উঠে এসেছে চীন। তাই এই সময় তালেবান সরকারকে তাদের সমর্থনের প্রেক্ষাপট আলাদা বলেই মনে করছেন কূটনীতিবিদদের একাংশ।
শুধু বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ হিসাবে উঠে আসা নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও অন্যতম শক্তিশালী দেশ চীন। এই মুহূর্তে চিনের অর্থনীতি ১৪ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি ডলার, যা ১৯৯৬ সালের তুলনায় প্রায় ১৭ গুণ বেশি। এশিয়া মহাদেশের একটি বড় এলাকায় নিজেদের ব্যবসার সম্প্রসারণ চাইছে তারা। আফগানিস্তানে এত দিন বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেনি চীন। আফগানিস্তান দখলের আগে চীনে গিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং ই-র সঙ্গে দেখা করেন তালেবান নেতারা। এ বার তালেবান ক্ষমতা দখল করায় সেখানে চীনের বাণিজ্যের বিস্তার অনেক বেশি হবে বলেই ধারণা কূটনৈতিক মহলের।
বিনিয়োগ নিয়ে চিন্তিত ভারত
যারা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ২০ বছর ধরে একটি গণতান্ত্রিক আফগানিস্তানের জন্য কাজ করেছেন, তাঁরা সবাই একটি বড় ধাক্কার সম্মুখীন হতে চলেছেন। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো মিত্র নয়, ভারতও রয়েছে।
ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, এবার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বড় শক্তিগুলোর কাছ থেকে তালেবান স্বীকৃতি নিয়ে নিতে পারে, এমন সম্ভাবনা রয়েছে। তারা যেভাবে কয়েক দিনের মধ্যে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে, তাতে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা কমে গেছে। তবে আফগানিস্তান তালেবান নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় ভারতকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। কারণ, আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতাবস্থা ফেরাতে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার অর্থ বিনিয়োগ করেছে ভারত। তালেবান–সংকট আফগানিস্তানে ভারতের বিনিয়োগকে ব্যর্থ করে দেবে কি না, তা নিয়ে এখন পর্যালোচনা করছেন বিশ্লেষকেরা।
আফগানিস্তানে ভারতের প্রধান আগ্রহ আঞ্চলিক যোগাযোগে দেশটির গুরুত্বের জন্য। ২০১১ সালে আফগানিস্তান পুনর্গঠনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে একটি কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তি করেছিল ভারত। এরপর ১০ বছর ধরে আফগানিস্তানে বিপুল অর্থ ভারত বিনিয়োগ করেছে। তালেবান নিয়ন্ত্রণের পর এ বিনিয়োগের কী হবে, এখন সেটাই প্রশ্ন।
কাবুলে আফগান পার্লামেন্ট ভারত তৈরি করেছিল। এতে আনুমানিক ৯ কোটি ডলার বিনিয়োগ হয়। ২০১৫ সালে ভবনটি চালু হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভবনটি উদ্বোধন করেন। সে সময় তিনি ভবনটিকে আফগানিস্তানের গণতন্ত্রের প্রতি ভারতের শ্রদ্ধা হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। বিশেষ করে ভবনটির একটি ব্লকের নাম রাখা হয়েছিল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির নামে।
আফগানিস্তানে ইরান সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় ২১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করেছে ভারতের বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন। কান্দাহার, গজনি, কাবুল, মাজহর-ই-শরিফ ও হেরাত শহরকে ছুঁয়ে গেছে এ রাস্তা। পাকিস্তানকে এড়িয়ে এ রাস্তা দিয়ে ইরানের চাবাহার বন্দর ব্যবহার করতে পারে নয়াদিল্লি। জরঞ্জ-দেলারাম নামের এই সড়ক তৈরিতে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ১৫ কোটি ডলার। এটি তৈরি করেছিলেন ৩০০ ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার। কাজ চলাকালীন তাঁদের মধ্যে ১১ জনের মৃত্যুও হয়।
আফগানিস্তানে ভারতের একটি উল্লেখযোগ্য সাহায্য হলো বিদ্যুৎ অবকাঠামোর সংস্কার। কাবুলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর জন্য বাঘলান প্রদেশের রাজধানী পুল-ই-খুমরি থেকে ২০০ কেভি ডিসি ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপন করা হয়। সেই সঙ্গে ভারতের প্রকৌশলীরা প্রদেশগুলোতে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার পুনরুদ্ধার করে।
২০১৬ সালে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সঙ্গেই সালমা বাঁধ উদ্বোধনে অংশ নিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভারত-আফগানিস্তানের বন্ধুত্বের নিশানস্বরূপ আফগানিস্তানের হেরাত প্রদেশে এই সালমা বাঁধ তৈরি করা হয়।