ড. মো. মোরশেদুল আলম
»স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের পর যোগাযোগ খাতে বাংলাদেশ নতুন যুগে প্রবেশ করছে। যানজট নিরসনে দেশে প্রথমবারের মতো চালু হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়াল মহাসড়ক। এটি বাংলাদেশ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ ভিত্তিক দেশের বৃহত্তম প্রকল্প। সিগন্যাল, ট্রাফিক জ্যামবিহীন এমন একটি উড়াল সড়ক দেশের মানুষের জন্য এখন আর স্বপ্ন নয়, বরং বাস্তব। উড়াল সড়কটি হযরত শাহজাজাল বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত যাবে। ঢাকা শহরের যানজট নিরসনসহ ভ্রমণে সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ের লক্ষ্যে এই উড়াল সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। এর ফলে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। এই অবকাঠামো যানজটের শহর ঢাকায় যাতায়াতে যানজট কমাবে, সময় বাঁচাবে, ভোগান্তি কমবে, স্বস্তি মিলবে। ২ সেপ্টেম্বর দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত অংশের উদ্বোধন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৩ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টা থেকে সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য এই উড়ালসড়ক খুলে দেওয়া হয়। এই সড়ক দিয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে কাওলা থেকে ফার্মগেটের তেজগাঁও আসতে সময় লাগবে মাত্র ১০ থেকে ১২ মিনিট। এই উড়াল মহাসড়ক নির্মাণের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজধানীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে নিরবচ্ছিন্ন চলাচল নিশ্চিত করা। ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রকল্পটির চুক্তি স্বাক্ষর হয়। প্রকল্পের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর সংশোধিত চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ২০১৪ সালের মধ্যে পুরো উড়াল সড়কের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা থাকলেও জমি বুঝে না পাওয়া, নকশায় জটিলতা ও অর্থায়নের অভাবে এর নির্মাণ কাজে এক যুগের বেশি সময় কেটে গেছে।
তবে কয়েক বছর ধরে প্রকল্পটির বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত কাজে কয়েকগুণ গতি পায়। পূর্ণাঙ্গ এক্সপ্রেসওয়েটি হবে ফার্মগেট, তেজগাঁও, মগবাজার হয়ে চিটাগাং রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত। মোট ২০ কিলোমিটার সড়কের সাড়ে ১১ কিলোমিটার পথ প্রথম পর্যায়ে খুলে দেওয়া হচ্ছে। এটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাওলা থেকে শুরু করে মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার হয়ে কুতুবখালী গিয়ে শেষ হবে। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ। ২০২৪ সালের জুনে কাজ শেষ করার লক্ষ্য প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের। কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশের মেইন লাইনের দৈর্ঘ্য ১১.৫ কিলোমিটার এবং র্যাম্পের দৈর্ঘ্য ১১.০ কিলোমিটার। র্যাম্পসহ মোট দৈর্ঘ্য ২২.৫ কিলোমিটার। এ অংশে ওঠানামার জন্য ১৫টি র্যাম্প রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি র্যাম্প যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। বাংলাদেশ সরকারের সেতু বিভাগের তত্ত্বাবধানে উড়াল মহাসড়কটি নির্মিত হচ্ছে। মূল উড়ালসড়ক ১৯.৭৩ কিলোমিটার। প্রকল্পে ওঠানামার জন্য ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি র্যাম্প বা সংযোগ সড়ক রয়েছে। র্যাম্পসহ উড়ালসড়কের মোট দৈর্ঘ্য ৪৬.৭৩ কিলোমিটার। বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত এই সাড়ে ১১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে আগে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লেগে যেত। বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট যেতে কাওলা, কুড়িল আর গলফ ক্লাবে ওঠার ব্যবস্থা থাকবে। একদিকে নামা যাবে বনানী ও মহাখালী আর ফার্মগেটে। অন্যদিকে, তেজগাঁও থেকে বিমানবন্দর যেতে বিজয় সরণি ওভারপাসের দুই প্রান্ত আর বনানী থেকে থাকবে ওঠার ব্যবস্থা। নামা যাবে মহাখালী, বনানী, কুড়িল ও বিমানবন্দর এলাকায়।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে ঢাকার যানজট কমবে। ফলে জনগণের ভোগান্তিও কমবে। এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে। আগে যেখানে বিমানবন্দর দিয়ে রাজধানীতে প্রবেশের পর যানজটের কারণে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগতো দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। সেখানে এই উড়াল সড়ক দিয়ে এই পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে ১০ থেকে ১২ মিনিট। ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত রুট এটি। এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ যাতায়াত করেন। এটি চালুর ফলে একদিকে উড়াল পথে দ্রুত যাতায়াত করা যাবে, অন্যদিকে নিচের সড়কে গাড়ির চাপ কমবে। ফলে ঢাকাবাসীর কর্মঘণ্টা বাঁচবে। রাজধানীর উত্তর অংশে গাজীপুর শিল্পাঞ্চল। সেখানকার বেশিরভাগই তৈরি পোশাক শিল্প। এসব রফতানি পণ্য রাজধানীর যানজট পেরিয়ে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরসহ নির্ধারিত গন্তব্যে যাওয়া ছিল বেশ কষ্টসাধ্য বিষয়। এই উড়াল সড়ক ধরে রাজধানীর চিরায়ত যানজট এড়িয়ে কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে রফতানি পণ্যবাহী যানবাহন। ফলে দেশের অর্থনীতির চাকা আরও সচল হবে। এই উড়াল সড়ক দেশের জন্য নব দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করবে এবং সরকারের যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ভিশন রয়েছে, সেই লক্ষ্যে আরও একধাপ এগিয়ে নেবে। এর ফলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাসহ রাজধানীবাসীর দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িত অনেক বিষয়ে ইতিবাচক পরির্বন ঘটবে। উন্নত বিশে^র শহরগুলোতে যেখানে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে আনা হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে এর উল্টোটি ঘটছে। ঢাকায় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করে। প্রতিদিন যোগ হচ্ছে প্রায় ৪০টি নতুন ব্যক্তিগত গাড়ি। বাড়ছে মোটরসাইকেলের সংখ্যাও। ব্যক্তিগত গাড়ির কারণে রাজধানীতে বাড়ছে যানজট। ব্যক্তিগত গাড়ি যাদের রয়েছে, তারা যখন এই উড়াল সড়ক ব্যবহার করবেন; তখন নিচের সড়কের চাপ অনেকটাই কমবে। মূলত প্রাইভেট গাড়ি এবং আন্তঃজেলা বাসগুলো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা বেশি পাবেন। নগরের মধ্য অঞ্চলে যারা বসবাস করেন যেমন ফার্মগেট বা এর আশেপাশের এলাকা থেকে যখন কেউ বিমানবন্দর বা উত্তরার দিকে যাবে তারা এই সুবিধাটা ভালোভাবে ভোগ করতে পারবেন।
প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার যানবাহন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যেতে পারবে। এক্সপ্রেসওয়েটি ঢাকা শহরের উত্তর অংশের সঙ্গে; মধ্য, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব অংশের যোগাযোগ উন্নত করবে এবং শহরের অভ্যন্তরে আশেপাশে ট্রাফিক সক্ষমতা বাড়াবে। এই উড়াল সড়ক দিয়ে একটি গাড়ি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার বেগে বিমানবন্দর এলাকার কাওলা থেকে ফার্মগেট পৌঁছাতে পারবে ১০ মিনিটে। সার্বিকভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজীকরণ ও আধুনিকায়ন করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখবে এই উড়াল সড়ক। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে যুক্ত করে বিমানবন্দর থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত আরেকটি এক্সপ্রেসওয়ে গড়ে তুলছে সরকার। এই দুই এক্সপ্রেসওয়ে পুরোপুরি চালু হলে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কসহ দেশের সবকটি জাতীয় মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হবে। ঢাকার সঙ্গে ৩০টি জেলার সংযোগ স্থাপনকারী আব্দুল্লাহপুর-আশুলিয়া-বাইপাইল-চন্দ্রা করিডোরে যানজট অনেকাংশে হ্রাস পাবে। সামগ্রিকভাবে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ০.২১৭ শতাংশ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।
উড়ালসড়ক ব্যবহার করতে টোল দিতে হবে। প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, পিকআপ ও হালকা ট্রাককে ৮০ টাকা, বাস ও মিনিবাস ১৬০ টাকা, মাঝারি ট্রাক ৩২০ টাকা এবং ভারী ট্রাক বা ট্রেইলরে ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে। এটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিতে নির্মাণ করা হচ্ছে। এ কারণে টোলের টাকা থেকে নির্মাণ ব্যয় তোলা হবে। প্রকল্পটিতে থাইল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইতাল থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানির ৫১ শতাংশ, চীন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপের ৩৪ শতাংশ এবং সিনোহাইড্রো করপোরেশনের ১৫ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। সাড়ে ২১ বছর উড়ালসড়কের টোল আদায় করে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগের টাকা তুলে নেবে। প্রকল্পটির ব্যয় শুরুতে ৩ হাজার ২১৬ কোটি টাকা ধরা হলেও পরবর্তী সময়ে তা বাড়িয়ে ১৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। প্রকল্পটি ঢাকা শহরের উত্তর-দক্ষিণ করিডোরের সড়কপথের ধারণক্ষমতা বাড়াবে। তাছাড়া প্রকল্পটি ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হলে ঢাকা ইপিজেড ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের যোগাযোগ সহজতর হবে। এতে ঢাকা শহরের যানজট নিরসনের পাশাপাশি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে।
লেখক: শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়