সুপ্রভাত ডেস্ক »
নগরের সাম্প্রতিক বিভিন্ন ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ছিনতাইকারীদের একটি তালিকা করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।
ছয় শতাধিক নামের এ তালিকায় থানায় থানায় নথিবদ্ধ ছিনতাইকারীদের নাম স্থান পেয়েছে। খবর বিডিনিউজের।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) নিহাদ আদনান তাইয়ান জানান, তালিকায় ছিনতাইকারীদের কয়েকটি ধাপে ভাগ করা হয়েছে। সক্রিয়, নিষ্ক্রিয়, কারাগারে আটক এবং ছিনতাই ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাদের নামও আছে এ তালিকায়।
গোয়েন্দা পুলিশের মাস দেড়েক আগের পরিসংখ্যানে যে সবমিলিয়ে তালিকায় ৬০৩ জনের নাম এসেছে, তার মধ্যে সক্রিয় ছিনতাইকারীর সংখ্যা ৪৭৩ জন, কারাগারে আটক আছে ৪১ জন, হদিস নেই ৪৬ জনের। বাকিরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে।
নাম-ঠিকানার পাশাপাশি কার বিরুদ্ধে কয়টি মামলা ও মামলার অবস্থা উল্লেখ আছে তালিকায়।
বন্দর নগরীর বিভিন্ন স্থানে ভোর এবং সন্ধ্যায় ছিনতাইকারীদের সক্রিয়তা দেখা যায়। ছোটখাট বিভিন্ন ছিনতাইয়ের ঘটনায় অনেক সময় ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন না।
সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ছিনতাইয়ের ঘটনায় যেসব স্থানে সিসি ক্যামেরা আছে, সেগুলো উদঘাটন হলেও সিসি ক্যামেরা না থাকলে সেসব ঘটনার কূলকিনারা করা কঠিন ঠেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।
গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার তাইয়ানের ভাষ্য, ‘এ তালিকা প্রস্তুতের কারণে ছিনতাইয়ের পর ছিনতাইকারী ধরা অনেকটা সহজ হয়েছে। বিভিন্ন ক্লুলেস ছিনতাইও পুলিশ শনাক্ত করতে পারছে।’
সাম্প্রতিক এমন একটি ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি জানান, জিইসি এলাকায় আইফোন ও টাকা পয়সা ছিনতাই হয়েছে বলে অভিযোগ করেন এক নারী। তবে তদন্তে নেমে অভিযোগ অনুযায়ী ওই এলাকায় ওইদিন কোনো ছিনতাইয়ের প্রমাণ পায়নি পুলিশ।
ডিবি কর্মকর্তা তাইয়ান বলেন, পরে তালিকা অনুযায়ী কাজ করে গোয়েন্দা পুলিশ ছিনতাইয়ের সাথে জড়িত একটি চক্রকে আটক করে জানতে পারে, ওই নারী ছিনতাইয়ের শিকার হলেও ঘটনাস্থলটি তিনি সঠিকভাবে উল্লেখ করেননি।
ওই নারী খুলশী থানার জিইসি মোড় সংলগ্ন জাকির হোসেন রোডে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার অভিযোগ করলেও ছিনতাইকারীরা জানিয়েছে, ঘটনাস্থল আসলে বায়েজিদ লিঙ্ক রোড এলাকা। পরে ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে মালামাল উদ্ধার করা হয়।
এর আগে ২০১৪ সালে নগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের পক্ষ থেকে ছিনতাইকারীদের একটি তালিকা করা হয়েছিল। যেখানে ছিনতাইয়ে সরাসরিযুক্ত ১০২ জনের নাম ছিল। এরপর দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেফতার হলেও ছিনতাইকারীদের কোনো নির্দিষ্ট তালিকা ছিল না।
প্রায় ১০ বছর পর নতুন তালিকা করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। তবে নতুন এ তালিকায় আগের তালিকায় থাকা বেশ কয়েক জনের নাম দেখা যায়নি।
নগরীর পুলিশের চারটি জোনের ১৬টি থানার এলাকা অনুযায়ী করা এ তালিকায় দক্ষিণ জোনের কোতোয়ালী থানা এলাকায় ছিনতাইকারীদের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ৫০ জন। যার মধ্যে ৩০ জন বর্তমানে সক্রিয়। আর ৯ জন কারাগারে আটক আছেন।
এবারের তালিকায় নগর পুলিশের এক সময়ের তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারী ১৬ মামলার আসামি ইদু মিয়া ওরফে হাতকাটা ইদু ছিনতাই ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন বলে উল্লেখ আছে।
ইদু ছিলেন নগর পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ছিনতাইকারী। যার অধীনে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের ২০ জনের বেশি সদস্যের একটি দল ছিল বলে পুলিশের ভাষ্য।
বিভিন্ন সময়ে পুলিশ কর্মকর্তারা বলে আসতেন, ইদু টাকা দিয়ে ছিনতাইকারী পুষতেন। বিভিন্ন গণপরিবহনসহ নানা জায়গায় তার অনুসারীরা পকেটমার, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটাতেন।
আরেকজন ছিনতাই ছেড়ে সবজি বিক্রি এবং অপর এক জন পোশাক কারখানায় কাজ করছেন বলে তালিকায় উল্লেখ করা হয়।
কোতোয়ালী থানা এলাকায় আগে ছিনতাইয়ের যুক্ত ছিল-এমন আটজনের কোনো হদিস পায়নি পুলিশ।
সদরঘাট থানা এলাকায় ২২ জনের নাম এসেছে, যাদের মধ্যে ৯ জন ছিনতাইয়ের সাথে জড়িত আছে। ওই এলাকায় তিনজন আগে ছিনতাই করলেও এখন ছেড়ে দিয়েছে বলে ডিবির তালিকায় বলা হচ্ছে।
তাদের একজন বর্তমানে ট্রাকচালক হিসেবে কাজ করেন। অন্যদের হদিস নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
চকবাজার থানার ২৯ জনের মধ্যে ক্রিয়াশীল হিসেবে ১২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কারাগারে আছেন ছয়জন।
তাছাড়া ওই এলাকায় পাঁচজন ছিনতাই ছেড়েছে, তাদের দুইজনের একজন বর্তমানে সবজি বিক্রেতা, একজন অসুস্থ হয়ে ভিক্ষুক হয়েছেন। অপর আটজনকে নিষ্ক্রিয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তালিকায় বাকলিয়া এলাকায় ৬৫ জনের নাম আছে। যাদের মধ্যে ৩৮ জন ছিনতাইয়ের কাজে জড়িত আছেন। পাঁচজন কারাগারে এবং ৯ জনের কোনো হদিস নেই।
এছাড়া তালিকায় উল্লেখ আছে পাঁচজন আগে ছিনতাই করলেও তারা বর্তমানে মাদক কারবারে জড়িয়েছে। বাকিরা ছিনতাই ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে বলে ডিবির ভাষ্য।
স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাদের মধ্যে দুইজন রিকশা চালক, একজন চটপটি বিক্রেতা, একজন মাছ ব্যবসা করছেন। এছাড়া একজন টমটম চালক, একজন কাপড়ের দোকানে এবং অপর একজন পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করছেন।
উত্তর জোনের পাঁচলাইশ থানা এলাকার ২৯ জন ছিনতাইকারীর মধ্যে ২৩ জন সক্রিয় থাকলেও বাকি ছয় জনের হদিস পাওয়া যায়নি।
চান্দগাঁও এলাকার ৫৮ জনের মধ্যে ৫২ জন ছিনতাইয়ের কাজে সক্রিয় আর চারজন কারাগারে আটক আছে। অপর দুই জনের মধ্যে একজন ছিনতাই ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে হোটেল ব্যবসা করছেন।
অপর একজন মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করলেও ছিনতাইকারীদের সাথে তার সখ্যতা আছে বলে সন্দেহ পুলিশের।
খুলশী থানা এলাকায় ছিনতাইকারীদের মধ্যে সরকার দলীয় নেতাদের অনুসারীও রয়েছে বলে তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এ তালিকায় সক্রিয় ৩৯ ছিনতাইকারীর মধ্যে হানিফ ও ওয়াসীম নামে দুইজন লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামীগের সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত বিশ্বাস হত্যা মামলার আসামি দিদারুল আলম মাসুমের অনুসারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে হানিফও সুদীপ্ত বিশ্বাস হত্যা মামলার আসামি।
আর আরিফ নামে একজন টেন্ডার সন্ত্রাসে জোড়া খুনের আসামি ও বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল আলম লিমনের অনুসারী। এছাড়া সাতজন আগে ছিনতাইয়ের সাথে জড়িত থাকলেও এখন নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তালিকায় বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকায় ৪২ জন সক্রিয় ছিনতাইকারী আছে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে পশ্চিম জোনের ডবলমুরিং থানা এলাকায় ৬, হালিশহর ১১ ও পাহাড়তলী থানা এলাকায় ৩০ জন সক্রিয় ছিনতাইকারীর নাম তালিকায় আছে।
তালিকায় আকবর শাহ থানার ৬৮ জনের নাম উল্লেখ আছে, যাদের মধ্যে ৬২ জন এখনও ছিনতাই করে বেড়ায়।
নগরীর শীর্ষ ছিনতাইকারী হামকা নূরের নামও আছে তালিকায়। আকবর শাহ থানা এলাকার ছিনতাইকারীদের নামের তালিকায় থাকা হামকা দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক আছেন।
বিভিন্ন সময়ে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, হামকা নূর আলম একজন ‘দুধর্ষ সন্ত্রাসী ও ছিনতাকারী’। ‘হামকা গ্রুপ’ নামে একটি সন্ত্রাসী দলের এই নেতা চট্টগ্রাম শহরজুড়ে ছিনতাই, অস্ত্রবাজি চালিয়ে আসছিলেন। পুলিশের করা ‘শীর্ষ ছিনতাইকারীদের’ তালিকাতেও তার নাম রয়েছে।
২০ মামলার আসামি নূর আলম ২০১৭ সালের দিকে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে কারাগারেই আছেন। তবে সেখানে বসেই তিনি বাইরে নিজের সহযোগীদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ রাখতেন এবং মাদকের কারবার চালিয়ে আসছিলেন বলে বিভিন্ন সময়ে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইয়াবাসহ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কারারক্ষী আটক হওয়ার পর ছিনতাইকারী হামকা নূর আলমের নাম আসে মাদক কারবারের তালিকায়ও। ওই সময় পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, কারাগারে বসে মাদকের কারবার করেন হামকা নূর আলম।
এছাড়াও আকবর শাহ এলাকার শাহীন ও নজরুল নামের দুইজন ছিনতাই ছেড়ে মাদক কারবারে জড়িয়েছেন বলে তালিকায় উঠে এসেছে। পাশাপাশি সাগর নামের এক ছিনতাইকারী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গাড়ি চালকের কাজ করছেন।
এদিকে বন্দর জোনের ইপিজেড থানা এলাকায় ৩৮ ছিনতাইকারীর নাম এসেছে তালিকায়। এছাড়া পতেঙ্গা থানা এলাকায় ১৩ জন ছিনতাইয়ের সাথে যুক্ত, দুইজন কারাগারে এবং কর্ণফুলী থানায় সাতজন সক্রিয় এবং চারজন কারাগারে আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে বন্দর থানা এলাকার তালিকায় ৭১ জনের নাম আছে। তাদের মধ্যে ৬১ জন ছিনতাইয়ের সাথে যুক্ত আর সাত জন কারাগারে আটক আছে।
বাকি তিনজনের মধ্যে দুইজন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে বর্তমানে অটোরিকশার চালক এবং অন্য একজন বন্দরে কাজ করেন বলেও উল্লেখ করা হয় তালিকায়।
গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার নিহাদ আদনান তাইয়ান বলেন, ‘এ তালিকা অনুযায়ী যাদের নাম আছে, তাদের বিষয়ে সবসময় নজরদারি করা হচ্ছে। ছিনতাইকারীদের অবস্থান অনুযায়ী তালিকাটি সবসময় হালনাগাদ করা হচ্ছে।’