কমলো টাকার মান
সুপ্রভাত ডেস্ক»
গত বছরের মাঝামাঝি থেকে রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় অতিরিক্ত মাত্রায় বাড়তে শুরু করে। এতে একদিকে তৈরি হয় ডলারের সংকট। এমন পরিস্থিতিতে ছোট ব্যবসায়ীদের অনেকেই ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। বিশেষ করে দেশের ছোট ও মাঝারি মানের আমদানিকারকরা ঋণপত্র খুলতে হিমশিম খাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের জন্য কোনও প্রতিকার নেই বলে জানিয়েছেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা। তারা বলছেন, ডলার সংকট, তাই এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে। খবর বাংলাট্রিবিউনের।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বর্তমানে ডলারের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক। অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দামে এলসি খোলা সম্ভব হচ্ছে না। আবার মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ৯৫ টাকা দরে রেমিট্যান্স কিনতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। এ কারণে এলসি খুলতে আসা ব্যবসায়ীদের অনেককেই ফেরত দিতে হচ্ছে।
দেশের আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত প্রতি ডলারের মূল্য ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। যদিও এ দামে কোনও ব্যাংকেই ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ডলারপ্রতি ৯০-৯৫ টাকা পর্যন্ত আদায় করছে। আর মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করছে ৯৮ টাকার কাছাকাছি।
যদিও ব্যাংকের বাইরে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে ৯৩ থেকে ৯৪ টাকায়।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ডলার ও টাকার বিনিময় হার স্বাধীনতার পর থেকে সরকার নির্ধারণ করে দিতো। টাকাকে রূপান্তরযোগ্য ঘোষণা করা হয় ১৯৯৪ সালের ২৪ মার্চ। আর ২০০৩ সালে এই বিনিময় হারকে করা হয় ফ্লোটিং বা ভাসমান। এরপর থেকে আর ঘোষণা দিয়ে টাকার অবমূল্যায়ন বা পুনর্মূল্যায়ন করা হয় না। তবে বিনিময় হার ভাসমান হলেও পুরোপুরি তা বাজারভিত্তিক থাকেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব সময়ই এতে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রেখে আসছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে ‘ম্যানেজড ফ্লোটিং রেট’ নীতি অনুসরণ করে আসছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এলসি খুলতে গেলে ব্যাংকাররা ডলারের যে দর বলছেন, সে দরেই ডলার কিনতে হচ্ছে। অর্থাৎ ৯৬ থেকে ৯৮ টাকা দরেও তাদের ডলার কিনতে হয়েছে।
এদিকে ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হয়ে টাকার অবমূল্যায়ন করছে। আর এই অবমূল্যায়ন যাতে খারাপ পরিস্থিতিতে না যায়, সে জন্য প্রতিদিনই বাজারে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
৯ মাসে দুই টাকার বেশি অবমূল্যায়ন
গত জানুয়ারি মাসের শুরুতে ডলারের বিনিময়মূল্য ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা করেছিল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর ২৩ মার্চ তা আবারও ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা করা হয়েছিল। এরপর ২৭ এপ্রিল ২৫ পয়সা বাড়িয়ে করা হয় ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা। গত ৯ মে আবার ২৫ পয়সা বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ১৬ মে ফলে এখন আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম গিয়ে ঠেকেছে ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড মূল্য।
যদিও গত বছরের ২১ আগস্ট পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। পরদিন ২২ আগস্ট প্রথমবারের মতো ৮৫ টাকা ছাড়ায়। এরপর চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি বেড়ে ৮৬ টাকায় পৌঁছায়। অর্থাৎ গত ৯ মাসের ব্যবধানে প্রতি ডলারে দর বেড়েছে দুই টাকা ৭০ পয়সা। গত ২০ দিনের ব্যবধানে তিন দফায় ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন হলো এক টাকা ৩০ পয়সা।
চলতি অর্থবছরে এরই মধ্যে বৈদেশিক রিজার্ভ থেকে ৫০৩ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এরপরও ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশের আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে বৃহস্পতিবার (১২ মে) ডলারের ঘোষিত দর ছিল ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা। যদিও ঘোষিত মূল্যের চেয়ে ৯-১০ টাকা বেশি দরে ব্যাংকগুলো ডলার লেনদেন করেছে।
মহামারির মধ্যে একবছরেরও বেশি সময় ধরে ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে।
এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এর সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ব্যাংকিং চ্যানেলে এখন ডলারের চাহিদা যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি। যেসব ব্যাংকের রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় ভালো, তারা অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় আছে। কিন্তু যাদের রেমিট্যান্স কম, তারা এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর কাছ থেকে ৯৪ টাকারও বেশি দামে ব্যাংকগুলো ডলার কিনছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হয়েছে ২ হাজার ২১৩ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫৪ শতাংশ বেশি। একইভাবে জ্বালানিতে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৮৭ শতাংশ আমদানি খরচ বেড়েছে। গত জুলাই-মার্চে আমদানি হয়েছে ৫৪৬ কোটি ডলারের জ্বালানি। এছাড়া ভোগ্যপণ্যের আমদানি খরচ বেড়েছে ৪১ শতাংশ, মূলধনি যন্ত্রের ৪২ শতাংশ ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানিতে ৫০ শতাংশ। এর ফলে সামগ্রিকভাবে জুলাই-মার্চ সময়ে আমদানি খরচ বেড়েছে ৪৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের রফতানি খাতে বড় প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও চলতি অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি রেকর্ড ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসেই সরকারের চলতি হিসাবে ঘাটতি তৈরি হয়েছে ১৪ বিলিয়ন ডলার। দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতিও ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। রেমিট্যান্সের মন্দাভাবের পাশাপাশি আমদানি প্রবৃদ্ধির চাপ সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় এ ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যদিও এ অবস্থায় আমদানিতে লাগাম টানার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যক্তিগত গাড়ি, হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক সামগ্রীর আমদানি ঋণপত্রের ন্যূনতম নগদ মার্জিন ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। আর নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়, এমন পণ্যের নগদ মার্জিন নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে ৫০ শতাংশ। এছাড়া ডলারের সংকট মোকাবিলায় সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ডলারের সরবরাহ এবং চাহিদার মধ্যে ব্যাপক তফাত দেখা দিয়েছে। এখন আমদানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু রেমিট্যান্স না বেড়ে উল্টো কমেছে। আবার রফতানি বাড়ছে চাহিদার চেয়ে কম।’ তিনি উল্লেখ করেন, বাজারকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের হাতটা একটু গুটিয়ে ফেলতে হবে। বাজারকে বাজারের মতো চলতে দিতে হবে। তাহলে ধীরে ধীরে বাজার স্থিতিশীল-স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ। রেকর্ড পরিমাণ এই আমদানি প্রবৃদ্ধি দেশের ২ হাজার ৪৯০ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি করেছে।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের অর্থে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ হতো। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
তবে আশার কথা, বর্তমানে রফতানি আয় বেশ ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। জুলাই-এপ্রিল সময়ে পোশাকের পর হোম টেক্সটাইল, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি ১০০ কোটি ডলারের মাইলফলকে পৌঁছেছে। পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানিও শতকোটি ডলার ছুঁই ছুঁই করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দুই মাস বাকি থাকতেই চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পণ্য রফতানি হয়েছে। এই অর্থবছরে পণ্য রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার। আর চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে রফতানি হয়েছে ৪ হাজার ৩৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য।