সুপ্রভাত ডেস্ক »
চট্টগ্রামের ‘আইকনিক’ সড়কের ঢালে গাছ কেটে র্যাম্প নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিল না করলে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে কয়েকটি সংগঠন। ‘গাছ বাঁচাও, চট্টগ্রাম বাঁচাও’ স্লোগান নিয়ে সোমবার বিকেলে টাইগারপাস মোড়ে নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের সমাবেশ থেকে এই ঘোষণা আসে। এতে বলা হয়, টাইগারপাস-সিআরবির শতবর্ষী গাছ কাটা যাবে না এবং চট্টগ্রামের একমাত্র দ্বিতল সড়কটি অক্ষত রাখতে হবে।
এই সংগঠনের নেতৃত্বেই ২০১১ সাল থেকে টানা ১৫ মাসের আন্দোলনে সিআরবিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে হাসপাতাল নির্মাণের প্রকল্প বাতিল হয়েছিল।
টাইগারপাস মোড়ে শতবর্ষী গাছের নিচে এই সমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘যদি র্যাম্প করতে হয়, অনেক জায়গা আছে এখানে। গাছ কেটে কেন করতে হবে? প্রকৃতি অক্ষুণœ রেখে যে কোনো কিছু করতে পারে, তারা সেটা করুক।’
তিনি বলেন, ‘মূল লক্ষ্য এসব শতবর্ষী গাছ ও দ্বিতল রাস্তাটি নষ্ট করে সিআরবির পরিবেশ ও প্রতিবেশ ধ্বংস করা। তারপর সিআরবিতে থাবা বসানো। শতবর্ষী গাছ কেটে নতুন চারা লাগানোর কোনো প্রয়োজন নেই।’ খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরী কমিটির সভাপতি একিউএম সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এই সড়ক শুধু চট্টগ্রামের নয়, দেশের ও বিশ্ব প্রকৃতির সম্পদ। যা সৃষ্টি করতে পারবেন না তা কেন ধ্বংস করছেন?’
প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে এই সম্পদ রক্ষার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, ‘অবিলম্বে সিডিএ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ঘোষণা দিন। নিউমার্কেট থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারের অনেক বিকল্প আছে।’
সভাপতির বক্তব্যে নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজি বলেন, ‘এত বিকল্প থাকতে কেন গাছ কেটে আর দ্বিতল রাস্তা ধ্বংস করে র্যাম্প করতে হবে সেটা বোধগম্য নয়।’
পরিবেশবাদী সংগঠন পিপলস ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, ‘আমরা কেউ উন্নয়ন বিরোধী নই। এই র্যাম্প এখানে কেন? এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করার সময়ও শুরুর স্থান নিয়ে সমস্যা হয়। এটা দেওয়ানহাট থেকে শুরু করা যেত। তা না করে পাহাড় কেটে লালখান বাজার থেকেই শুরু করা হয়।
অধ্যাপক মো ইদ্রিস আলী বলেন, ‘যারা সিআরবি ধ্বংস করতে পারেনি তারা এখন সিআরবির প্রতিবেশ ধ্বংস করতে চায়। তারা শতবর্ষী গাছ কেটে চারা লাগাতে চায়। ধিক্কার জানানোর ভাষা আমাদের নেই।’
সাংবাদিক প্রীতম দাশের সঞ্চালনায় সমাবেশে সাংবাদিকদের সংগঠন বিএফইউজের যুগ্ম মহাসচিব মহসীন কাজী, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সহসভাপতি চৌধুরী ফরিদ, সাংবাদিক ঋত্তিক নয়ন, আমিনুল ইসলাম মুন্না ও সারোয়ার আমিন বাবু, নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম, খাল নদী রক্ষা কমিটির আলীউর রহমান, লেখিকা মোহছেনা ঝর্ণা, রাজনীতিবিদ সাজ্জাদ হোসেনও বক্তব্য রাখেন। খবর বিডিনিউজ।
‘গাছ আপনার কী ক্ষতি করে?’
এর আগে দুপুরে আরেকটি শতবর্ষী গাছের নিচে কর্মসূচি পালন করে ‘সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন’। এতে অংশগ্রহণকারীদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘বেঁচে থাকা গাছ আপনার কী ক্ষতি করে’, ‘উন্নয়নের করাত থেকে গাছেদের মুক্তি দাও’, ‘এসব মহিরুহ আমাদের প্রাণ’, ‘গাছ কাটার আগে আমাদের কাট’ ইত্যাদি।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক মু. সিকান্দার খান বলেন, ‘প্রকৃতি থেকে যে আমরা নানা সুবিধা পাই, এসব নিয়ে তাদের জানাশোনা, জ্ঞান নেই। এসব জায়গায় যারা বসেন, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।’
ছায়াঘেরা সড়কটিতে র্যাম্পের পরিকল্পনা
বন্দর নগরীর ‘আইকনিক’ সড়ক হিসেবে পরিচিত টাইগারপাস থেকে সিআরবিমুখী পাহাড়ি রাস্তাটির মাঝের ঢালে এলিভিটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণ করতে চায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
সেজন্য জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে রেলওয়ের কাছে এবং পাহাড়ের ঢালে থাকা ৪৪টি গাছ কাটার অনুমতি চেয়ে বন বিভাগের কাছে আবেদনও করা হয়েছে। ওই আবেদন অনুমোদন পেলে সেখানে তিন ডজনের বেশি শতবর্ষী গাছ কাটা পড়বে।
নগরীর লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা।
প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নামে নাম পাওয়া এ এক্সপ্রেসওয়ে গত বছরের নভেম্বরে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সময়মত কাজ শেষ করতে না পারায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে ওই সময়ের মধ্যেও পুরো কাজ শেষ হবে না। এক্সপ্রেসওয়ের ১৪টি র্যাম্পের মধ্যে একটি জিইসি মোড়ে, দুটি টাইগারপাসে, চারটি আগ্রাবাদে, একটি ফকিরহাটে, দুটি নিমতলায়, দুটি সিইপিজেডে এবং দুটি কেইপিজেডে নির্মাণ করা হবে।
টাইগারপাস মোড়ে দুটি র্যাম্পের মধ্যে একটি হবে সিআরবি হয়ে নিউ মার্কেটমুখী সড়কে, অন্যটি হবে আমবাগানমুখী সড়কে। দেওয়ানহাট ব্রিজের শেষ প্রান্ত সংলগ্ন অংশ থেকে টাইগারপাস মোড় ঘুরে সড়কের মাঝ বরাবর গিয়ে পলোগ্রাউন্ড বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের অংশ পর্যন্ত হবে যাবে প্রস্তাবিত র্যাম্পটি। এটি নির্মাণে ১৪ শতক জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে গত ২৫ মার্চ বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে চিঠি দিয়েছেন সিডিএ এর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস। কেটে ফেলার জন্য ইতোমধ্যে গাছগুলো চিহ্নিত করে ফেলেছে সিডিএ।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এপ্রিলের মাঝমাঝি আমরা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করতে চাই। তবে এখনো র্যাম্পের কাজ শেষ হয়নি। ছয়টি র্যাম্পের কাজ আমরা একসাথে শুরু করেছি। যেটির কাজ যখন শেষ হবে, সেটি চালু হবে। ‘টাইগারপাসে দুটি র্যাম্প হবে। নিউ মার্কেট থেকে টাইগারপাসমুখী র্যাম্পটি ধরে গাড়ি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠবে। এতে করে নিউ মার্কেট এলাকা থেকে যেসব গাড়ি এলিভিটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে চায় তাদের জন্য সহজ হবে। আর বিপরীতে আমবাগানমুখী র্যাম্পটি ধরে যানবাহান এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নামবে।’
কাজী হাসান বলেন, লালখান বাজারে গাড়ি নামার সুযোগ থাকবে। কিন্তু সেখানে ওঠার ব্যবস্থা থাকবে না। ওঠার জন্য আরেকটি র্যাম্প থাকবে জিইসি মোড় সংলগ্ন হোটেল পেনিনসুলার সামনে।
‘১৫টি র্যাম্পই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে করা হয়েছে। যাতে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সব এলাকা থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠা-নামা করা যায়।’
টাইগারপাস থেকে সড়কটি সিআরবি পাহাড়ের পাশ দিয়ে চলে গেছে পলোগ্রাউন্ড ও বিআরটিসি মোড় হয়ে নিউ মার্কেটের দিকে। এই সড়কের টাইগারপাস থেকে পলোগ্রাউন্ড পর্যন্ত অংশে সড়কটি পাহাড়ের ঢালে উপরে ও নিচে। এই সড়কের উপরের সিআরবি সংলগ্ন অংশটিতে গাড়ি চলে নিউ মার্কেটমুখী। আর নিচের রেলওয়ে কলোনি সংলগ্ন অংশটিতে গাড়ি চলে টাইগার পাসমুখী হয়ে। দুই সড়কের মাঝে পাহাড়ের ঢালে আছে শ খানেক বিভিন্ন আকারের গাছ।
পাহাড়ি ঢালের ওই অংশটিতেই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণ করতে চায় সিডিএ। সেজন্য ওই ঢালে থাকা গাছগুলোর মধ্যে ৪৪টি গাছ কাটতে চায় সিডিএ।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সিডিএ এর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বলেন, ‘দেখুন, উন্নয়ন কাজ করতে গেলে কিছু গাছ হয়ত কাটা পরে। কিন্তু বিপরীতে আমরা অনেক বেশি সংখ্যায় গাছ রোপণও করি। যেমন আউটার রিং রোডে ২০ হাজার গাছ কাটা পড়েছে। লাগানো হচ্ছে ৫ লাখ গাছ। এই প্রকল্পেও আমরা অনেক গাছ রোপণ করব।’