অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী »
সাম্প্রতিক যে মর্মান্তিক ঘটনাটি বিশ্বকে কাঁদিয়েছে তা হল সংগীতশিল্পী জুবিনের মৃত্যু। শিল্প ও শিল্পীর যে মৃত্যু নেই, ভৌগলিক সীমা রেখা নেই, জাতি ধর্ম বর্ণে যে শিল্পীর বিচার হয় না তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে জুবিনের মৃত্যুতে।
১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে মেঘালয়ের তুরা শহরে জন্ম জুবিনের। এরপর আসামের জোর হাটে স্বপরিবারে চলে যান। সেখানেই আমৃত্যু বসবাস। বাবা ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট পাশাপাশি একজন গীতিকার। মা ছিলেন সংগীতশিল্পী। মা-বাবার প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণায় সংগীতে অভিষেক। দু-বোন এক ভাই ছিল হরিহর আত্মা। আসামের একটি স্কুলে পড়াশোনা। গানে হাতেখড়ি মায়ের কাছে।
১৯৯২ সালে মাত্র বিশ বছর বয়সে গানের অ্যালবাম বোরোয় এবং সাড়া পড়ে যায়। গানই হয়ে ওঠে ধ্যান জ্ঞান। ২০০২ সালে সড়ক দূর্ঘটনায় বোনের মৃত্যুতে মারাত্মকভাবে মর্মাহত হন জুবিন। প্রবেশ ঘটে নেশার জগতে কিন্তু থেমে থাকেনি গান। কালের পরিক্রমায় প্রায় ৪০টি ভাষায় ৩৮ হাজার গান রেকর্ড করেছেন। ভাবা যায়! ২০০৬ সালে বলিউডে পদার্পন। অনুরাগ বসুর গ্যাং স্টার সিনেমায় ইয়া আলী মাদাত আলী গেয়ে পুরো বিশ্বে ঝড় তোলেন। লিখেছেন অসংখ্য গান, সুর করেছেন। অভিনয় করেছেন, প্রযোজনা, পরিচালনা কিছুই বাদ যায়নি। জুবিন প্রমাণ করেছেন তিনি নিজেই ইন্ড্রাস্ট্রি। ব্রাহ্মণ সন্তান হয়েও তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ গোত্রের ওরে নিজেকে নিয়ে গেছেন। বলিউডে নিজের সুন্দর অবস্থান তৈরি করেছেন, প্রচুর অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছেন বৈকি, অকাতরে করেছেন দান। দুঃস্থ, অসহায়, নির্যাতিত, নিপীড়িত বয়োবৃদ্ধ সবার জন্য ‘জুবিন দা’ সাক্ষাত মর্তের দেবতা। লন্ডন, আমেরিকা, কানাডা, দিল্লি, মুম্বাই দাপিয়েছেন গান গেয়ে কিন্তু সুযোগ সামর্থ্য থাকলেও ফিরে এসেছিলেন আসামে। আমৃত্যু আসামেই, আসামবাসীও তাকে বিশ্ব নাগরিক করে তুলেছে। কখনো রাতের আঁধারে নির্যাতিতা মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছেন, করোনায় নিজের দুয়ার খোলা রেখেছেন সবার জন্য, প্রতিদিন হাজারো মানব শিশুর অন্ন সংস্থান করেছেন নিরবে, নিভৃতে। নিঃসন্তান শিল্পী বাগান থেকে পাওয়া অসহায় কিশোর অরুণকে দিয়েছেন পুত্র মর্যাদা, এমনকি নিজের গোত্র, বর্ণও। অরুণই দিন শেষে তার মুখাগ্নি করে। একজন শিল্পী যে এতটা জনপ্রিয় হতে পারে, একজন মানব যে দেবত্বেরও সীমা অতিক্রম করতে পারে অন্তত তা প্রমাণিত হয়েছে জুবিনের মৃত্যুতে। তার শোক যাত্রায় ১৭ লক্ষ মানুষের উপস্থিতি ঘটেছিল। তাদের গগনবিদারী হাহাকার বিশ্বকে থমকে দিয়েছে। জীবিতকালে জুবিন বলেছিলেন, আমি মরলে আসাম ৭ দিন বন্ধ থাকবে, ঠিকই আসাম সরকার ৭ দিন রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। মাইকেল জ্যাকসনের পর জুবিনের শোকর্যালী স্থান পেয়েছে বিশ্ব রেকর্ডে। এতে জুবিনের কিছু যায় আসে না। সৃষ্টিশীল মানুষ কিছুটা পাগলও হয়। সে পাগলকে সবাই বুঝতে পারে না। কিন্তু আসাম ইন্ডাস্ট্রি বুঝেছে। আসামে তথা ভারতীয় সংস্কৃতিতে ও ইন্ডাস্ট্রিতে আগামী শতাব্দীতেও অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন জুবিন তার কর্মযজ্ঞে। তিনি চেয়েছেন ‘মায়াবিনী রাতের বুকুত’ গান গেয়ে তাকে বিদায় জানাবে মানুষ। আসামবাসী বুক ভরে ঠিক গেয়েছে। জুবিনের চিতাভস্ম ব্রহ্মপুত্রে ভাসিয়ে দেবার কথা তিনি নিজেই বলেছিলেন।
শিল্পের ধ্বংস হয় না, শিল্পীর মৃত্যু হয় না। দেবতা মানুষের কাছে হার মানে যখন মানুষটি স্রষ্টা হয়ে যান। জুবিন তোমায় কেউ বিদায় দেয়নি, তোমার দেহান্তর হয়েছে, হয়তো নতুন ইতিহাস রচনার প্রয়াসে, জীবনানন্দের মতো তুমিও আবার আসবে গাঙচিল হয়ে।