আজহার মাহমুদ »
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। যাকে বলা হয় বাংলাদেশের একটি এফেলিয়েট বিশ্ববিদ্যালয়। ২১ অক্টোবর ৩০ বছর পূর্ণ করে ৩১ বছরে পা দিবে দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর ভালোবাসার এই বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আবেগ, ভালোবাসা আর মায়া জড়িয়ে আছে দেশের বড় একটা শিক্ষার্থীর হৃদয়ে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে অভিযোগ থাকতে পারে, রাগ থাকতে পারে, অভিমান থাকতে পারে। তবে দিন শেষে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলেই অনেক শিক্ষার্থীরা একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছে।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, গাজীপুর জেলার বোর্ডবাজারে ১১.৩৯ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ অধিভুক্ত কলেজের তদারকি করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় বাড়তি চাপ কমাতে ও অধিভুক্ত কলেজগুলোর মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৯২ সালের ২১শে অক্টোবর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ (২০১৩-১৪) নতুন সিলেবাসের মাধ্যমে চার বছর মেয়াদী স্নাতক(সম্মান) ও এক বছর মেয়াদী স্নাতকোত্তর কোর্স চালু করেছে। এছাড়াও তিন বছর মেয়াদী স্নাতক (পাস) কোর্স এবং চার বছর মেয়াদী স্নাতক (সম্মান) প্রফেশনাল কোর্স রয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পি.এইচ.ডি. ও এম.ফিল. এর ব্যবস্থাও আছে।
দেশের স্নাতক পর্যায়ের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় অর্ধেকই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি বেসরকারি কলেজ আছে ২২৭৪টি। এর মধ্যে ২৭৯টি সরকারি কলেজ। স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয় ১৮১টি সরকারি কলেজে। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৮ লক্ষ। দেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরিব পরিবার থেকে উচ্চশিক্ষায় আসা সর্বোচ্চ সংখ্যক ছাত্রদের আশ্রয়স্থল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু কষ্টের বিষয় হচ্ছে, উচ্চশিক্ষার সবচেয়ে বেশি অবহেলা আর উদাসীনতার শিকার এই বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯২ থেকে ২০২৩। ৩০ বছরের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েও দৃশ্যমান উন্নতির ছোঁয়া পাচ্ছে না এ বিশ্ববিদ্যালয়। অভিজ্ঞতা বলে, বিশ্ববিদ্যালয়টির ব্যয় যত বেড়েছে ভোগান্তিও বেড়েছে তত বেশি। ২০১৪ সালের পরে সেশন জট কিছুটা কমলেও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্মাণ করা হয়নি পর্যাপ্ত ক্লাসরুম, পরীক্ষার হলরুম, অধিকাংশ কলেজে নেই পর্যাপ্ত শিক্ষকও।
যে সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা অনেক আগেই নিরাশায় পরিণত হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২৮ বছরেও প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি মেলাতে পারেনি। বছরের পর বছর কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর অনাদরে সমস্যার স্তুপ জমতে জমতে পাহাড়সম আকার ধারণ করেছে। এই পাহাড় ডিঙোনোর মন্ত্র খোদ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আছে কিনা তাও ভেবে দেখা প্রয়োজন।
রুলস-রেগুলেশন অনুযায়ী বছরে ৩৬৫ দিনে ২১০ দিন ক্লাস হওয়ার কথা থাকলেও ক্লাস হয় মাত্র ২৫-৩০ দিন। অনেক অনেক কলেজে দেখা যায় বছরে একটি ক্লাসও হয় না। এক্ষেত্রে শুধু শিক্ষক কিংবা কলেজের উপর দোষ চাপানো ঠিক হবে না। অনেক ক্ষেত্রে ছাত্ররাও কলেজে কিংবা ক্লাসে উপস্থিত থাকে না। তবে এর দায়ও কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টি এড়াতে পারে না। কারণ শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাসে আসছে না, কি তাদের সমস্যা এসব তদারকি করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের। এবং ক্লাসে ছাত্রদের টানতে না পারার ব্যর্থতা কলেজের শিক্ষকদেরও নিতে হবে। এজন্য যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
এতো সমস্যার মধ্যেও সমস্যা বেড়েই চলে। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষরাও তাই এ বিশ্ববিদ্যালয়কেও ছোট মনে করে। মনে হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই দেশের ভবিষ্যৎ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কিছুই না। এর দায়ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের নিতে হবে। কারণ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি এমন কোনো কার্যক্রম করেনি যা দেশের মানুষের কাছে আমাদের তোলে ধরতে সহায়ক হয়েছে। আর আমাদের পাঠদান সম্পর্কে সকলের মুখস্থ আছে। সবেই জানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যরয় মানে কি, কেমন। আর তাই যারা ক্লাস করতে চায় না তাদের এ বিশ্ববিদ্যালয়টি সাজেস্ট করে অনেকে। মানে পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দেওয়া ছাড়া আর কাজ নেই। এটাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
শুধু এসব সমস্যাতেই শেষ নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি অন্যতম দাবী হচ্ছে সমাবর্তন। যা অন্যসকল বিশ্ববিদ্যালয় করলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারছে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ বছরে একটি মাত্র সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাও ২৫ বছর পর প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় ১৭ জানুয়ারি ২০১৭ সালে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিশ্ববিদ্যালয়টির আচার্য্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ খানের উপস্থিতিতে এই সমাবর্তনটি হয়েছিলো। এরপর আবারও নিশ্চুপ বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তৃপক্ষরা। পাঁচ বছর সমাপ্ত হয়ে গেলো এখনও ২য় সমাবর্তনের দেখা পেল না শিক্ষার্থীগণ। এ দায় কার, শিক্ষার্থীদের না জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের? প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবে না জাতি। তবুও রেখে গেলাম।
নিয়মিত ক্লাস, এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকদের মাধ্যমে পাঠদান, নিয়মিত এসাইনম্যন্ট, প্র্র্যাকটিক্যাল সহ কøাসের উপস্থিতির মাধ্যমে ইনকোর্স নম্বর প্রধান করতে হবে। কিন্তু অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় ক্লাসে উপস্থিত থাকার চাইতে প্রাইভেটে উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক। এতেই মিলে যায় ইনকোর্স নম্বর। এসব সমস্যার সমাধান যতদিন হবে না, ততদিন এমন পরিবেশ থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়টির। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত সমাবর্তন চায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এটা শুধু চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকার শিক্ষার্থীদের নয়, দেশের ৬৪টি জেলার শিক্ষার্থীদের দাবি এটা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেশের সকল কলেজের শিক্ষার্থীরা একসাথে মিলে এই আন্দোলন করছে। তাদের সকলের প্রাণের দাবি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন। আমি মনে করি এটা একটি যৌক্তিক দাবি। এতো বড় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন হয়না এটা শুনতেই অবাক লাগে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ এটা নিয়ে আশাকরি ভাববেন।
এছাড়াও ২৮ লাখ শিক্ষার্থীর অন্যতম ও প্রধান চাওয়া হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন। বিশ্ববিদ্যালয়টির আচার্য্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি যদি এ বিষয়ে সদয় দৃষ্টি রাখেন তবে এর একটি সমাধান হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। সেইসাথে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি শিক্ষার্থীদের সকল চাওয়া পূরণ করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তিনি শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণে শতভাগ সফল। তাই তার নজর যদি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দিকে থাকে তাহলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা অচিরেই সমাধান হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবহেলা শব্দটি মুছে যাক। দেশব্যাপি ছড়িয়ে পড়–ক এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম। সেই সাথে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সকল আশা যেন পূরণ হয় সেই প্রত্যাশা রাখছি। এগিয়ে যাক প্রিয় বিশ^বিদ্যালয়।
প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
পেশা: সাংবাদিকতা