হাফিজ রশিদ খান
এ কথা ইতিহাসবিদিত সত্য যে, স্মরণাতীতকাল থেকেই বৃহত্তর বাংলা জনপদের মানুষেরা স্বাধীনচেতা মনোভাবের অধিকারী ছিলেন। তাঁরা গোত্রীয় সম্প্রীতির বন্ধনে ঐক্যবদ্ধভাবে বহিরাগত শাসক ও তাদের প্রতাপী কিন্তু বেগানা সংস্কৃতিকে প্রতিকূল বিবেচনায় প্রতিহত করতে কসুর করেননি কখনও। এই জনপদের মানুষেরা শৌর্যবীর্যের সমস্ত বারুদ বিনিয়োগ করে স্বভূমির ধারাবাহিক জীবনধারার মাহাত্ম্য ও সাংস্কৃতিক প্রাতিস্বিকতা রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। অতীতের বিভিন্ন ঔপনিবেশিক কঠোর শৃঙ্খল তথা কাক্সিক্ষত বন্ধনমুক্তির স্বাদ থেকে দীর্ঘকাল তাঁরা বঞ্চিত ও পীড়িত থেকে গেলেও সেই তেজোদীপ্ত জীবনস্পৃহা কোনোকালেই তামাদি হয়ে যায়নি বা তাঁরা সেই স্পৃহা কস্মিনকালেও হারিয়ে ফেলেননি। প্রাগিতিহাস ও ঐতিহাসিক কালের এ যাবত প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্তে এই জনপদের মানুষের দুর্নিবার ও সংশপ্তক মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ জাতিস্মর চেতনার আলোকে আমাদের মুগ্ধ, প্রাণিত ও অহংকারী করে, সন্দেহ নেই। তারপরও নিজেদের মধ্যে অনাকাক্সিক্ষত ভেদাভেদের কদর্য নীতির উপস্থিতির কারণে ইতিহাসের নির্মম ও নিষ্ঠুর আচরণ ও অবহেলার শিকার হয়েছে এই জনপদের স্বাধীনচেতা সন্তানেরা। তাঁরা নিপীড়ন-নির্যাতনের মাধ্যমে আর্য, মোগল-পাঠান-তুর্কি-ব্রিটিশ-পাকিস্তানি এসব নানা নামধারী বহিরাগত শক্তির দ্বারা অধিকৃত, শাসিত ও শোষিত হয়েছে দীর্ঘকাল।
সর্বশেষ বিংশ শতাব্দীর প্রান্তিক চল্লিশের দশক থেকে সত্তর দশকের প্রারম্ভিক কাল পর্যন্ত আজকের বাংলাদেশের মানুষ ‘পাকিস্তান’ নামক মেকি স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যের রাষ্ট্রে নতুন মোড়কে দলিত, অবদমিত, শোষিত, লাঞ্ছিত ও ধর্মীয় দৃষ্টির অপপ্রয়োগে ‘আতরাফ’ বা নিম্নবর্গীয় পর্যায়ে প্রতারিত হয়েছে সেই একই কিসিমের শাসকদের বুট ও বেয়নেটের ঔদ্ধত্যের দ্বারা। সেই বহিরাগত ধর্মীয় অহমিকাযুক্ত কর্তৃত্ববাদী শাসনকাল ঘোর অমানিশায় ঢেকে রেখেছিল এই বাংলার ২৩ বছরের কাল পরিসরকে। প্রাগিতিহাস ও ঐতিহাসিক কালের পূর্বাপর ইতিবৃত্তের সূক্ষ্মদর্শী অনুপঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ এই প্রকা- আলোকময় সত্যকে প্রকটিত করে যে, একজন শেখ মুজিবুর রহমানই এই জনপদের প্রকৃত ভূমিপুত্ররূপে ত্রাতার ভূমিকায় যেন মাটি ফুঁড়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন মুক্তির প্রজ্বলিত মশাল হাতে নিয়ে। অনাচারের বিরুদ্ধে অনন্যমাত্রিক দ্রোহী, দেশপ্রেমী, লড়াকু পূর্বসূরিগণের মহৎ আত্মা ও তাঁদের লালিত চৈতন্যের সুগঠিত, সুসংবদ্ধ সুবেদিতাকে তিনি লালন ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিপুল গৌরবে তাঁর অবিসংবাদী রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে। প্রায় এককভাবেই তাঁর জন্মভূমির প্রগাঢ় সন্তানদের ঋণ পরিশোধ করেছেন দৃপ্ত, সুস্পষ্ট আধুনিক রাজনৈতিক ভাষা ও কর্মসূচির অঙ্গীকারে। জাতিকে বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হিশেবে মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন তাঁর ইতিহাস-সম্বুদ্ধ জাগ্রত নেতৃত্বের গুণে। এটিই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রধান অর্জন ও মহিমা।
যে স্বাধীন ভূভাগ আজ বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ নামে তার উন্নত মস্তক উত্তোলন করে রেখেছে, তার মাটির প্রতি রন্ধ্রে-রন্ধ্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রক্তকণিকা দ্রবীভূত হয়ে আছে ফুলে-ফলে ও ফসলে। তাঁর ব্যক্তিসত্তাকে তিনি বিলীন করেছেন এই ভূভাগের সকল মানুষের মিলিত জাতীয় সত্তার বিনির্মাণে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ভিত্তিপ্রাপ্ত এই দেশমাতৃকা লাখো জীবনের উৎসর্জনে যে বেদনাবিধুর অভিজ্ঞানের ভাষ্য প্রকাশ করতে চায় উদ্গ্রীব উঁকিঝুঁকিতে, তাহলো, হে সন্তানেরা, মাথা উঁচু করেই বাঁচো। দেশমাটি ও মানুষের প্রতি গভীরতর সমবেদনা ও দায়িত্ববোধে নমিত, প্রশস্ত ও প্রথিত হও।
এই উপলব্ধির প্রকৃত ও প্রমিত সংজ্ঞা হতে পারেÑ ‘মায়া’। এই মায়া মানে সর্বোচ্চ আনুগত্যশীলতা, সর্বোচ্চ আত্মাহুতির পর আপনা থেকেই যা হৎলোকে গৃহীত ও প্রস্ফুটিত হয় দরাজ অভিব্যক্তির আনন্দে। কবি ভারতচন্দ্র এটিকেই বলেছেন, ‘তব মায়া ছান্দে, বিশ^ পড়ি কান্দে’। এদেশের কিছু ইতিহাস-বিস্মৃত মানুষের মনে মুক্তিযুদ্ধ ও রক্তার্জিত স্বদেশের স্বাধীনতার প্রতি যে এই ‘মায়া’র বেশুমার ঘাটতি রয়েছে, তা বেদনাদায়ক হলেও বিহ্বল হবার মতো কিছু নয়। বিশে^র ইতিহাসে, পুরাণে, ধর্মীয় আখ্যান ও সিলসিলায় এই ‘মায়াহীন’ মানুষেরা দুর্গত ও অপআত্মারূপেই পরিকীর্তিত, নিন্দিত ও অভিশপ্ত হয়েছে। বস্তুত, যে-লোকেরা তাদের নিজের অন্তরের তাগিদের বাণী শুনেও শুনতে পায় না, আশপাশের জনসমাজকে দেওয়ার মতো খাঁটিকথা বা দর্শন তাদের ভা-ারে জমা থাকবেই বা কী করে? এই মানসিকতাকেই তো বলা হয় ঔপনিবেশিক মানসিকতা।
বলাবাহুল, ‘ঔপনিবেশিকতা হচ্ছে আগ্রাসী শক্তি ও আক্রান্ত গোষ্ঠির এক বিশেষ ধরণের চৈতন্যের কাঠামো ও মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা। উপনিবেশগুলি থেকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুনাফা অর্জনের প্রক্রিয়া অবশ্যই ঔপনিবেশিক চৈতন্যের কাঠামোর পক্ষে অবিচ্ছিন্ন ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে আরও অনেক উপাদান ঔপনিবেশিক চৈতন্যের কাঠামোকে নির্মাণ ও নির্ধারণ করেছিল। ঔপনিবেশিকতার পলিটিক্যাল ইকনমি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু ঔপনিবেশিকতার সব থেকে স্থূল ও নীরস বহিঃপ্রকাশ ঘটে মনস্তাত্ত্বিক স্তরে। আর এই সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর নির্মাতা আগ্রাসী ও শাসিত উভয় ধরণের শক্তিই। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শ পরিপূর্ণভাবে প্রকট হ’য়ে ওঠার সত্তর বছর আগে থেকেই ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সক্রিয় হ’য়ে উঠেছিল এবং সেই সঙ্গে এ কথাও স্পষ্ট যে, উত্তর ঔপনিবেশিক পর্বে ভারতীয় সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে ও কোণে ঔপনিবেশিক মতাদর্শের প্রভাব খুব স্পষ্টভাবেই দৃশ্যমান।’ (পোস্টকলোনিয়ালিজম : উত্তর ঔপনিবেশিকতা, সম্পাদনা : সমীর রায়চৌধুরী, পৃ. ১১০ )
এই ঔপনিবেশিক মানসিকতা সম্পন্ন তথা ‘মায়া’হীন মানুষগুলোর ইতিহাস-উচ্ছেদী কালাপাহাড়ি আচরণ সন্ত্রাসেরই অন্য নাম। এরা জাতির মেরুদ-ে বেগানা হাড়ের অনাকাক্সিক্ষত যন্ত্রণাদায়ক উপস্থিতি। ওই ঔপনিবেশিক উদ্বাস্তুতাকে জাতীয় ইতিহাসের ব্যাপক ও সহজতর পঠনপাঠনের সুযোগ-সুবিধা অবারিত করার মাধ্যমে প্রতিহত করা সম্ভব। সেই সঙ্গে যুগ-যুগ ধরে গ্রামবাংলার মানুষের মুখে-মুখে প্রচলিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কিংবদন্তি, লোককাহিনি এবং মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মনুষের বীরত্বগাথা তুলে ধরতে হবে বিভিন্ন মাধ্যমে। সেখানে অনিবার্যভাবে উচ্চারিত ও সংগ্রথিত থাকা জাতির পিতার ভাষণ ও সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক বচন ও ভূমিকা নবনবরূপে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে, যা অন্ধকারের উদর থেকে জন্ম নেয়া বিকৃতিকে সরিয়ে দেবে। ঠিক যেমন পানাভরা পুকুরের অপ্রয়োজনীয় স্তরটিকে আলগোছে সরিয়ে দিয়ে স্বচ্ছ সলিলে অবগাহন করা হয়।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অবলোকন এই যে, রাজনৈতিক মত-মতবাদ বা ধারা-উপধারা নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয়তা ও জাতির পিতার মহৎ অবদানের প্রতি তর্পণ অতি অবশ্যই হতে হবে সম্মিলিত ও জাতীয়ভাবে নিরংকুশ শ্রদ্ধামিশ্রিত ও তাৎপর্যপূর্ণ সম্ভ্রমের অভিরাগে। এটি জাতীয় অভিব্যক্তি নির্মাণ ও জাতীয় রাজনীতির বহুধা বিস্তৃত গণতান্ত্রিক মানসকেও উন্নততর স্তরে নিয়ে যেতে সহায়ক চালিকাশক্তিরূপে কাজ করবে।