জুয়েল আশরাফ
আদালত প্রাঙ্গণে ভিড় বেড়ে চলেছে। কিছু মানুষের তাড়াহুড়া, উত্তেজনা। কিন্তু আদালত কক্ষে নীরবতা। নৃশংস হত্যাকাণ্ডের একজন আসামির বিচার চলছে। আসামি বিনামূল্যে আইনজীবী প্রদানের সরকারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। অপরাধী আবদুল গফুর বললেন, হুজুর! আমি আমার অপরাধের পরিণতি জানি, তবে আমার কিছু বলার আছে। আমার উকিলের দরকার নেই! আপনি অনুমতি দিলে আমি কি শুরু করব?
বিচারকের মহিমান্বিত কন্ঠ ঘরে প্রতিধ্বনিত হল, অনুমতি!
আপনার দয়া হুজুর!
কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর আবদুল গফুর বলতে লাগলেন, হুজুর! আমার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ সত্য। আমি অস্বীকার করতে পারব না। কিন্তু আমার পুরো ঘটনা শোনার পর নিশ্চয়ই ভেবে দেখবেন, এই ঘটনার আসল অপরাধী কে? বলেই আবদুল গফুর আবার চুপ। তার নীরবতার সাথে বিচারকের মহিমান্বিত কণ্ঠ আবারও প্রতিধ্বনিত হয়। বিচারক বললেন, আপনি না থেমে আপনার কথা বলতে থাকুন! আপনি যা বলছেন তা রেকর্ড করা হচ্ছে। আপনার বক্তব্যে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া হবে।
বিচারকের দিকে কৃতজ্ঞদৃষ্টিতে তাকিয়ে আবদুল গফুর বললেন, হুজুর! আমি আমার পরিবার ও ছোট দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখেদুঃখে বসবাস করছিলাম। আমি কেরানির চাকরি করি। কাজ করে আমার সংসার ভালোই চলছিল। ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে। তাদের অভাব নেই, আমার স্ত্রী মারজানও পাশের এলাকায় কাজ করতে যেতো রোজ।
ওইদিন মারজান কাজ থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল। গ্রামের তিনজন লোক প্রকাশ্যে তাকে তুলে পাশের মাঠে নিয়ে গেল। তিনজনই জোর স্বেচ্ছাচারিতা করার পর মারজানকে তার জিব বন্ধ রাখার হুমকি দেয়। তাকে বাড়ির কাছে পৌঁছে দেয়।
কাকতালীয়ভাবে আমি সেদিন কাজ থেকে জলদি বাড়ি ফিরে এসেছি। প্রথমে মারজানের অবস্থা দেখে ভাবলাম, হয়তো তার শরীর ভালো নেই। কিন্তু তার সাথে ঘটে যাওয়া দুর্দশার কথা বললে আমার চোখ দিয়ে রক্ত চলে আসে। আর কিছু না ভেবে সেই তিনজনের বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। গ্রামের বড় মাথাদের সামনে আমার কোনো মর্যাদা নেই, তাদের বিরুদ্ধে কোনো গ্রামবাসীর সমর্থনও পাচ্ছিলাম না। তাহলে বুঝতেই পারছেন, আমার কি হয়েছে? আমি সেই ক্ষমতাবান মানুষদের হাতে পরাস্ত হলাম। কিন্তু আমার অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেতনা কমেনি। আমার ভেতরের আগুনও নিবেনি। আইনের প্রতি আমার আস্থা ছিল। তাই মারজানকে সঙ্গে নিয়ে ঘটে যাওয়া দুর্দশার রিপোর্ট লিখতে থানায় পৌঁছালাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেল, রিপোর্টটাও টাকা দিয়ে লিখতে হবে। সেই সময় আমার কাছে টাকা ছিল না। সেখানেই একজন এমন কুৎসিত কথা বলল যে, শুনে আমার রক্ত টগবগ করে ওঠে। কসম করে বলছি, সেই সময় আমার স্ত্রীর প্রতি আমার দায়-দায়িত্ব না থাকলে ওখানেই ওই লোকটাকে বেগুন চাপা দিতাম। পরে ফাঁসিতেও ঝুলিয়ে রাখতাম! কোনোরকমে মারজানকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
পরের দিন এক বন্ধুর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে মারজানকে নিয়ে থানায় ফিরে যাই এই আশায় যে, এখন অবশ্যই রিপোর্ট লেখা হবে। কিন্তু এটাও আমার ভুল প্রমাণিত হলো যখন আমি সেখানে পৌঁছালাম সাথে সাথে আমাকে গ্রেফতার কা হলো। আমি আমার নাম বললাম। তারা আমাকে মারধর শুরু করে। দেখা গেল, ওই তিন ব্যক্তি আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে ইতিমধ্যেই আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা রিপোর্ট লিখেছে। বারবার আমার স্ত্রী হাতজোড় করে আমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করার পর একজন বলল, ঠিক আছে, আপনি যদি বলেন, আমি তাকে ছেড়ে দিচ্ছি। আপনার লোকটিকে বুঝিয়ে দিন সে যেন তার অবস্থানে থাকে। গোলমাল করবে না এদের সাথে।
তারা কাগজে কী লিখেছিল তা আমি জানি না। ওই লোক জোর করে আমার ও আমার স্ত্রীর সিগনেচার করিয়ে আমাদের থানা থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। আমরা এখন কী করব? আমাদের কাছে শুধু আইনের আশ্রয় ছিল।
আমরা কমজোর মানুষ ও অসহায় ছিলাম। গ্রামে বসবাস করে সেসব মানুষের বিদ্রƒপের চোখ সহ্য করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তাদের দেখে মারজানের অপমানের স্মৃতি বুকে শিখার মতো জ্বলে ওঠে। আপনিই বলুন হুজুর, যে মানুষ তার স্ত্রীকে ভালোবাসে সে তার অপমান কীভাবে সহ্য করবে? বারবার আমাদের ঠাট্টা করতে করতে ওইসব মানুষগুলো পোড়া ঘায়ে লবণ ছিটিয়ে দেওয়ার মতো কাজ করত। আমি মারজানের বিচার পাওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি কিন্তু সেসব ক্ষমতাবান মানুষের টাকা আর প্রবেশাধিকারের সামনে আমি সবসময় দুর্বল ও নেতিবাচক প্রমাণিত হয়েছি।
আল্লাহ আমার পক্ষ থেকে ন্যায়বিচার করেছেন। সেই তিনজন লোকের মধ্যে দুইজন করোনা মহামারিতে মারা গেছে। যন্ত্রণায় মৃত্যুর খবর পেয়ে আমি কিছুটা স্বস্তি পেলেও বিচার তখনও অসম্পূর্ণ। প্রধান শিকারি এখনও জীবিত। ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য আমি একটি পরিকল্পনা করলাম। তা পূরণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি।
পাথর উত্তোলনকারী শ্রমিকের কাছ থেকে অজুহাত তৈরি করে আমি পাথর বিস্ফোরণের জন্য কিছু বিস্ফোরক নিলাম। রাতের আঁধারে ওই শিকারির টিউবওয়েলের মোটরের সুইচের সঙ্গে শক্তিশালী বিস্ফোরকটি এমনভাবে লাগিয়ে দিলাম যে, সুইচটি চালু করলেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হবে আর বিস্ফোরকটি আগুন ধরে যাবে। আমার পরিকল্পনা সফল হয়। পরের দিন সকালে বেচারা টিউবওয়েলের মোটর চালু করার সাথে সাথেই বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তে শিকারিকে এমন টুকরো টুকরো করে ফেলা হলো যে পরিবারের সদস্যদেরও তার টুকরো সংগ্রহ করতে কঠোর পরিশ্রম করতে হলো। আমি চাইলে পালানোর চেষ্টাও করতে পারতাম। কিন্তু না দেশ ও সমাজকে একটা বার্তা দিতে হল। আর সেজন্যই ওই দুর্বৃত্তের টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে আমি নিজেই থানায় হাজির হলাম।
হুজুর! আমরা যদি বিচার পেতাম তাহলে আমরা এভাবে অপরাধী হয়ে উঠতাম না। আইন নিজের হাতে তুলে নিতে হতো না। তাই আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন, দয়া করে বলুন, কতদিন চলবে এই আত্মসম্মান নিয়ে খেলা? মজলুমের ওপর অত্যাচারের অন্ধকার রাতের কোনো সকাল কি নেই? আমার দ্বারা সংঘটিত অপরাধের জন্য পুলিশ প্রশাসন, আইন ও সমাজ কি দোষী নয়? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিন, বাকি আমি আইনের অপরাধী। আপনি যা শাস্তি দেবেন, আমি সব মেনে নেব, হুজুর! বলেই আবদুল গফুর হাত দুইটি গুটিয়ে চুপ হয়ে গেলেন।
আদালত কক্ষে আবার নীরবতা। টেবিলে রাখা কাগজে কিছু একটা লিখে বিচারকের চোখ পড়ল আবদুল গফুরের মুখের দিকে। বিচারকের ধৈর্যশীল এবং গম্ভীর কণ্ঠ আবারও আদালতের কক্ষে প্রতিধ্বনিত হলো। বিচারক বললেন, আবদুল গফুর সাহেব, আপনার প্রতি আমাদের পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে। আপনার এবং আপনার স্ত্রীর সাথে যা কিছু ঘটেছে তা অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং দুঃখজনক। যেকোনো আত্মমর্যাদাশীল পুরুষ স্ত্রীর অপমান সইতে পারে না। কিন্তু আপনি কি জানেন না যে, আমাদের এই স্বাধীন দেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদের অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ? আমাদের দেশে আইনের শাসন আছে। অর্থাৎ এখানে আইনের সম্মতিতে প্রতিটি কাজ করা হয়। যা লঙ্ঘন না করার বাধ্যবাধকতা এদেশের প্রতিটি নাগরিকের। সে আপনার মতো সাধারণ মানুষ হোক বা খুব বিশেষ কোনো ব্যক্তি হোক! আইন সবার জন্য সমান। ন্যায়বিচারের দায়িত্ব যখন আদালতের ওপর আসে, তখন বাদী-বিবাদী কে তা দেখা হয় না। কারণ এতে ন্যায়বিচার যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আদালত বাদী-বিবাদীর দিকে অন্ধভাবে তাকিয়ে প্রদত্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের আলোকে আসামিদের মধ্যে প্রকৃত অপরাধীর মুখ দেখতে পায় এবং তারপরই ন্যায্য রায় দেয়। আদালত অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তাদের কাজ করে। সেজন্যই সবার চূড়ান্ত বিশ্বাস আইনের ওপর। দেশে আইনের শাসন আছে, এমন কথাও বলতে শোনা গেছে মানুষকে। এমতাবস্থায় আমার পূর্ণ সমবেদনা জানাতে গিয়ে আমি নিশ্চিতভাবে বলব যে, আপনি যা বলেছেন সব আমলে নিয়ে, যারাই এ বিষয়ে অবহেলা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হবে। দোষী প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে পুলিশ হোক বা থানার অফিসার। আপনিও ছাড়া পাবেন না, কারণ আমরা চাই না সমাজ ও দেশের কাছে এই বার্তা যাক যে, আপনি যদি সঠিক হন তাহলে আইন হাতে নিন। না, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া কখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের আওতায় হত্যার বিচার করা হবে। দোষী প্রমাণিত হলে আইনের ধারা অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হবে।
হা হা হা.. হঠাৎ আবদুল গফুর হেসে উঠলেন। বললেন, আবারও গরিব, অসহায় ও বাধ্যতামূলকের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। বুঝতে পারলাম, নীরবে অত্যাচার সহ্য করা গরিব, নিঃস্ব ও অসহায়দের ভাগ্যে ছিল, আজও আছে এবং থাকবে ভবিষ্যতেও। এই অন্ধকার রাতের কোনো সকাল নেই। শুনলাম বিচারক হুজুর! এই অন্ধকার রাতের কোনো সকাল নেই! হা হা হা!
আর একবার আবদুল গফুরের হাসি প্রতিধ্বনিত হল আদালত কক্ষে। বিচারকের মুখে অসহায়ত্বের ছাপ ফুটে উঠল। চেয়ার থেকে ওঠে নিজের চেম্বারে চলে যাওয়ার আগে আদালত আগামীকাল পর্যন্ত স্থগিত ঘোষণা করলেন।