নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার »
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরের বর্জ্য ও মলমূত্রের কারণে কৃষকের শত শত একর আবাদি জমি চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। গত সাড়ে চার বছর ধরে অনাবাদি পড়ে আছে বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষিজমি। এতে শত শত স্থানীয় কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দাবি জানিয়েছেন।
উখিয়ার বৃহত্তর মাছকারিয়া বিলের সীমান্তে কুতুপালং এলাকায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বসবাস। তাদের বর্জ্যে মাছকারিয়া বিলের শেষাংশে কৃষকের শত শত একর জমি মারাত্মকভাবে বিষাক্ত হয়ে অনাবাদি হয়ে পড়েছে। এছাড়া বালুখালী ও থাইনখালী খালেরও একই অবস্থা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে কিছু ড্রেন বিলে এসে মিলিত হয়েছে। ড্রেনের পুরোটা মলমূত্র, প্লাস্টিকের বোতল, অপচনশীল ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর। ফলে বর্জ্যে ভরাট হয়ে গেছে ড্রেন। মূলত রোহিঙ্গা শিবিরের অপচনশীল এসব ময়লা-আবর্জনা ও মানববর্জ্য সরাসরি ড্রেনে ফেলা হয়। গত প্রায় সাড়ে চার বছরে একবারও ড্রেন পরিষ্কার করা হয়নি। ফলে উৎকট দুর্গন্ধে মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে এলাকার পরিবেশ।
ভুক্তভোগী কৃষকদের অভিযোগ, সম্প্রতি দফায় দফায় মৌখিক ও লিখিতভাবে বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের জানালেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে প্রতিবছর বৃষ্টি নামলে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে অপচনশীল দুর্গন্ধময় এসব বর্জ্যে ভরপুর হয় কৃষকের কৃষিভূমি। তাতেই চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পড়ে শত শত একর জমি।
কৃষক লোকমান হাকিম, নজরুল ইসলাম ও আব্দুর রহমান বলেন, ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে বর্জ্যে কোনো ফলন হচ্ছে না জমিতে। বর্জ্যের কারণে বিস্তীর্ণ জমিতে চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইতিমধ্যে তারা (কৃষকেরা) চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী পরিচালক ও উপজেলা চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাওয়া যায়নি।
টেকনাফের রইক্যং পুটিবুনিয়া এলাকার কৃষক রাজু মিয়া (৩৫) জানান, এই অঞ্চলের মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। হালচাষে এই খালের পানি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু রোহিঙ্গা সম্প্রদায় আসার পর চার বছর ধরে এই খালে বর্জ্য ফেলার কারণে এটি মরা খালে পরিণত হয়েছে। এ কারণে চাষ বন্ধ রয়েছে। একসময় এ খালের পানিতে চাষাবাদ করে পুরো বছরের সংসার চলত তার।
কৃষক আকতার উদ্দিন ভুলু বলেন, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে এই খালে জোয়ার-ভাটা বন্ধ। অথচ খাল থেকে আমরা মাছ ও কাঁকড়া শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতাম। গেল চার বছরে এই খালের জোয়ার-ভাটা দূরের কথা, পানি দূষিত হয়ে উল্টো দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এখন কৃষিকাজ বন্ধ থাকায় আর্থিকভাবে আমরা কষ্টে আছি। সংশ্লিষ্টদের জানানোর পরও কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
জেলা উপকূলীয় পল্লী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি নূরুল আমিন ছিদ্দিক জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিষাক্ত বর্জ্য ও দূষিত দ্রব্যে এলাকার সাত-আটটি খাল দূষিত হয়ে উঠছে। এসব দূষিত পদার্থের কারণে পরিবেশ দূষিত হওয়ার পাশাপাশি ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। এ ছাড়া দূষিত দ্রব্যে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট, খালগুলো ভরাট হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দারা চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক খালগুলো রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
উখিয়া কুতুপালংয়ের দুই কৃষক জাফর আলম ও কায়ছার আলম বলেন, কৃষি জমিতে রোহিঙ্গাদের বর্জ্য পরিষ্কার করে চাষাবাদের ব্যবস্থা নেই বিধায় অনাবাদি পড়ে আছে এসব ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি। বর্জ্যের বিষাক্ত পানিতে অনুর্বর হয়ে পড়া জমি নিয়ে আমরা (কৃষকরা) পড়েছি চরম দুর্ভোগে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য ইঞ্জিনিয়ার হেলাল উদ্দিন বলেন, কৃষকদের এই সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছি। দফায় দফায় কৃষকদের দুর্ভোগ নিরসনে ক্যাম্প প্রশাসন ও এনজিও কর্মকর্তাদের অনেকবার অবহিত করার পরও কোনো সাড়া মেলেনি। মূল্যবান এই কৃষিজমির মাটিকে বর্জ্যমুক্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে বার বার ধর্ণা দেওয়া সত্ত্বেও কোনো সমাধান হয়নি বলে জানান এই জনপ্রতিনিধি।
উখিয়া সদর রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে পরবর্তী কয়েক মাস গণহত্যা ও নির্যাতনের মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে থাকে। এর আগেও বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে আসে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। সবমিলিয়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে এসে আশ্রয় নেয়।
এদিকে সর্বাত্মক চেষ্টা করেও সরকার একজন রোহিঙ্গাকেও নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরাতে পারেনি। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বারবার আশ্বাস দিলেও মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নানা টালবাহানা করছে। ইতোমধ্যে দেশটিতে সামরিক শাসন ফিরে আসায় প্রত্যাবাসনের আলোচনাও অনেকটা থমকে আছে। এই অবস্থায় লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ। কক্সবাজারের জনজীবনে কিছুটা চাপ কমাতে এক লাখ রোহিঙ্গা নাগরিককে নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়ায় পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে।