অমল বড়ুয়া »
বাংলা ভাষার একটি উল্লেখযোগ্য উপভাষা হলো চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা; যাকে চাটগাঁইয়া ভাষা বলা হয়। চাটগাঁইয়া ভাষা হল ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠীর একটি সদস্য ভাষা এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান ভাষা।এটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ইন্দো-আর্য শাখার পূর্বাঞ্চলীয় উপশাখা বাংলা-অসমিয়া পরিবারের সদস্য। সমগোত্রীয় অন্যান্য ভাষাসমূহ হল বাংলা, অসমিয়া, ওড়িয়া, রোহিঙ্গা, চাকমা এবং বিহারি ভাষা। অন্যান্য বাংলা-অসমিয়া গোত্রের ভাষাসমূহের মতো চাটগাঁইয়া ভাষা পালি ভাষা থেকে এসেছে যা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের একটি কল্পিত পূর্বসূরি। চাটগাঁইয়া ভাষার শব্দভান্ডণ্ডার মূলত পালি থেকে আসলেও এই ভাষায় প্রচুর পরিমাণে আরবি, ফারসি, তুর্কি, ইংরেজি, পর্তুগিজ শব্দ রয়েছে। চাটগাঁইয়া ভাষায় এসব বিদেশি ভাষা থেকে আগত শব্দের পরিমাণ এবং প্রভাব বাংলার চেয়ে বেশি এবং চাটগাঁইয়াতে সংস্কৃতের প্রভাব অন্যান্য ভারতীয় ভাষার চেয়ে অনেকটা কম। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে চট্টগ্রামের ভাষার প্রাবাল্য দেখে অনেকে মনে করেন ‘চর্যাপদ’ চাটগাঁইয়া ভাষায় রচিত। বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন উপভাষা হিসেবে চাটগাঁইয়া ভাষার রয়েছে সমৃদ্ধ ও স্বতন্ত্র শব্দভাণ্ডার। এই ভাষায় রচিত হয়েছে অনেক গদ্য-পদ্য, ছড়া-গান-নাটক, গল্প-উপন্যাস ও লোককাহিনি। সৃষ্টি হয়েছে নিজস্ব স্বতন্ত্র সাহিত্যধারা। এরূপ সাহিত্যধারার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- চাটগাঁইয়া প্রবাদ। চাটগাঁর প্রবাদ উপমানির্ভর হলেও এতে রয়েছে সুনিপুণ প্রাজ্ঞতা, অর্থদ্যোতকতা, গভীর মর্মার্থ, দারুণ রসবোধ ও ঋদ্ধ সাহিত্যগুণ। প্রতিটি প্রবাদে সমাজজীবনের বাস্তবচিত্র যেমন পরিস্ফুট হয়েছে, তেমনি সাহিত্য ও শিল্পের পরিশীলিত মননেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
]‘ফুয়াদেল্লাই ছাড়িত ন পারির, কেডারলাই গিলিত ন পারির।’
যার অর্থ- ‘স্বাদের জন্য ছাড়তে পারছি না, কাঁটার জন্য গিলতে পারছি না।’ মূলত উভয় সংকট বুঝাতে এই প্রবাদটি ব্যবহার করা হয়। এই প্রবাদটিতে মাছের স্বাদ ও কাঁটার উপমাকে খুবই সুন্দর ও নিখুঁতভাবে উপস্থাপর করা হয়েছে। এ-রকম আরেকটি প্রবাদ হচ্ছে :
‘হাত পাঁচ চইদ্দ, দুই টিয়া নইদ্দ।’
যার অর্থ- ‘সাত-পাঁচ চৌদ্দ, দুই টাকা দিয়ো না।’ এই প্রবাদ ঠগবাজদের কারসাজির একটা উদাহরণ। মানুষকে ঠকানোর জন্য যে কুটচাল ব্যবহার করা হয়, তা বোঝাতে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়। বর্তমান সমাজের সর্বত্রই ঠকবাজদের দৌরাত্ম্য অসহনীয় পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। যার ফলে সমাজে বিরাজ করছে আস্থাহীনতা ও বিশ্বাসহীনতার সংস্কৃতি। মানুষ মানুষকে প্রতারিত করছে। ফলে অনৈতিকতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে বড় ও সম্মানিত লোকদের প্রতি অসম্মান প্রর্দশনের ঘটনা। আমরা সম্মানিত ও যোগ্য ব্যক্তির কদর করছি না। এ বিষয়ে প্রবাদ আছে :
‘ঘর’র গরু ঘাঁডার খের ন খায়।’
অর্থ – ‘ঘরের গরু বাড়ির পথের ঘাস খায় না।’ প্রবাদে ব্যবহৃত উপমার অর্থ হচ্ছে নিজ এলাকার জ্ঞানী, পণ্ডিত ও যোগ্যব্যক্তিকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হয় না। বরং বাইরের অযোগ্য লোকদের ডেকে খাতির করা হয়। অনেকে আবার নিজেকে জাহির করতে চায়। নিজেকে জাহির করতে গিয়ে তার অতীতের সম্ভাব্য সুযোগকে হাতছাড়া করার বিষয়টিকে বড় করে উপস্থাপন করেন। সেটা বোঝাতে বলা হয় :
‘ধাইলে মাছ বড় অই যায়।’
অর্থ- ‘পালিয়ে যাওয়া মাছটি বড় হয়ে যায়।’ অতীতে হাতের কাছে প্রাপ্ত সম্ভাব্য সুযোগ গ্রহণ না করায় আজ খারাপ অবস্থায় আছে, না হয় অনেক কিছু করতে পারতোÑ এরকম গালগল্পে আসর মাতানো অনেক মানুষ সমাজে আছে। তাদের বিদ্রƒপ করার জন্য এই প্রবাদটি উপস্থাপন করা হয়। নিজেকে অতিচালাক, অতি জ্ঞানী ও পণ্ডিত মনে করে সর্বক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে চায় এরকম লোক সমাজে প্রায়শ দেখা যায়। তারা তাদের মূর্খতা ও অজ্ঞতা সম্পর্কে জানে না। তাদের জন্য প্রবাদ হচ্ছে :
‘হাইল্লে ঠিল্লে বাজে বেশি।’
‘খালি কলসি বাজে বেশি’Ñ এই প্রবাদ সমাজের পণ্ডিতন্মন্য ও অন্তঃসারশূন্য মানুষদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। সমাজে বসবাসরত মানুষের শেখার কোনো শেষ নেই। কিন্তু যারা নিজেরা শিখতে চায় না তাদের শেখানো যায় না। তাদের যতই অনুরোধ-উপরোধ আদেশ-উপদেশ প্রদান করা হোক না কেন, তাদের চিন্তা-চেতনার হেরফের হয় না। ঘটে না কোনো পরিবর্তন। এটা বোঝাতে বলা হয় :
‘অইলে ন বছরে অয়, নঅইলে নব্বই বছরেও নঅই।’
যার অর্থ- ‘হলে নয় বছরে হবে, না হলে নব্বই বছরেও হবে না।’ বিশেষত শিশু-কিশোর ও যুবক-যুবতীদের শাসনের ক্ষেত্রে এই প্রবাদ ব্যবহার করা হয়। অনেক অভিভাবক সন্তানদের বিগড়ে যাওয়ায় বিরক্ত হয়ে বলেন :
‘লাথির কাট্টল লাথি ন হাইলে ন পাকে।’
অর্থ- কাঁঠালকে লাথি-কিল না দিলে পাকে না। সুনিপুণ উপমার এই প্রবাদের অর্থ হলো : ‘সুন্দর ব্যবহারে কাজ আদায় না হলে শাস্তি দিয়ে বা খারাপ ব্যবহার করে কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন বা আদায় করতে হয়।’ শাস্তিহীনতার কারণে সমাজে বাড়ছে নৈতিক স্খলন। সমাজে বাড়ছে বয়োবৃদ্ধদের প্রতি অসম্মান। তাই অনেকে আক্ষেপ করে বলেন :
‘বাইন্ধে চুলে, পিন্ধে কড়ে যেন মউত অই।’
যার অর্থ- বেঁধে রাখা চুলে এবং কাপড়-চোপড় ঠিক থাকা অবস্থায় যেন মৃত্যু হয়। আমাদের সমাজে বৃদ্ধ বয়সে পিতামাতারা পুত্রসন্তানদের ভালোবাসা ও সেবা-শুশ্রুষা থেকে বঞ্চিত হন। তাঁরা ঠিক মতো আহার-পথ্য পান না। অবহেলার শিকার হন। অনেককে ঠাঁই নিতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে; কিংবা মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। শেষ বয়সে এসে এ রকম বঞ্চনা, অবহেলা ও মানবেতর জীবনের কষ্ট থেকে মুক্তিলাভের আশায় বয়স থাকতে আত্মনির্ভরশীল অবস্থায় যাতে মৃত্যু হয়’- এই অর্থে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
‘মিডের লাভ পিড়েয় খায়।’
অর্থ- মিঠার লাভ পিঁপড়ায় খায়। সমাজে বাড়ছে মুনাফালোভী অতি পুঁজিবাদী মানুষের সংখ্যা। তারা সবকিছুতে নিজের লাভ ও উন্নতি করতে চায়। এর জন্য তারা নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। অতিলোভী মানুষেরা প্রকারান্তরে ঠকে যায়। তা বোঝাতে এই প্রবাদটি বলা হয়।
‘তেল্লর মাতাত তেল’
যার আছে তাকেই সবাই দেয়, যার নাই তাকে কেউ দেয় না। এতে সামাজিক বৈষম্য ও অসমতার রূপটি সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। নিজের না থাকলে অন্যেও দিতে চায় না। নিজের সম্পদ ও আয়ের ওপর যেমন ভরসা করা যায়, তেমন অন্যের ওপর করা যায় না। তাই বলা হয় :
‘জামাইর কামাই ফুতি-ফুতি, পুয়ার কামাই মুতি-মুতি।’
নিজের স্বামীর আয়ে আরাম-আয়েশ করে জীবনযাপন করা যায়। কিন্তু স্বামীর অবর্তমানে সন্তানের আয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কারণ ছেলের আয় ছেলের বউ নিয়ন্ত্রণ করে। তখন নিজের স্বাধীনতা থাকে না। নিজের সুদিন আর থাকে না। তাই বলা হয় :
‘যাদ্দে দিন ভালা, আইয়েদ্দে দিন খারাপ।’
অর্থ- যাচ্ছে দিনটিই ভালো, আসছে দিন খারাপ। বর্তমানকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার কথা এখানে ওঠে এসেছে। অতীতের দুঃখকষ্টের যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট না থেকে এবং ভবিষ্যতের সুন্দর দিনের আশা না করে বর্তমানকে নিয়ে সুখে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।
‘আগের আল যেইক্কা, পিছের আল হেইক্কা।’
অর্থাৎ- আগের হাল যেদিকে যায়, পেছনের হালও সেদিকে যায়। একটি পরিবারে বড়জন যদি সৎ ও সুন্দর পথে চলে তাহলে ছোটজনও সৎ ও সুন্দর পথে চলে। বিস্তৃত অর্থে- একটি সমাজ বা দেশের নেতা যদি সৎ, যোগ্য ও দুরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে সমাজকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করে, তবে সমাজ যোগ্য নেতৃত্বের বদৌলতে সঠিক, সুন্দর পথে চলে; আর নেতা যদি অসৎ ও অযোগ্য হয় তাহলে সমাজও সেই পথে যায়। এই প্রবাদে যোগ্য নেতৃত্বের বিষয়টিকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
‘ভালার তারিফ, হালায় গরে।’
অর্থ : ভালো কাজের তারিফ সবাই করে। ভালো ও সৎ কাজের প্রশংসা সবাই করে। যে কাজ নিজের ও মানুষের মঙ্গলের জন্য সমর্থিত ও সমাজের উন্নয়নে নিবেদিত, সেই কাজের প্রশংসা সবাই করে।
‘হাইটটে হাইটটে নলা, গাইতে-গাইতে গলা।’
অর্থ- হাঁটতে হাঁটতে নলা, গাইতে-গাইতে গলা। অধ্যবসায় ও পরিশ্রম ছাড়া কোনো কাজ সম্পাদন করা সম্ভব নয়। তাছাড়া কোনো কিছু অর্জন করতে তার জন্য ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, একাগ্রতা, ক্রমাগত অধ্যবসায় ও পরিশ্রম করে যেতে হবে। তাই বলা হয়, পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি। অধ্যবসায় ও পরিশ্রম করলে যেকোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব।
চাটগাঁইয়া ভাষার এই প্রবাদসমূহের সূতিকাগার চর্যাপদ। প্রাচীন চর্যাপদে প্রবাদের যে সরস ও নিগূঢ় সারমর্ম পরিলক্ষিত হয়, তারই প্রচ্ছন্ন প্রভাব এই চাটগাঁইয়া প্রবাদেও পাওয়া যায়। তাই বলা যায়, চট্টগ্রামে প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষার প্রবাদসমূহ হাজার বছরের বাংলা িেলাকসাহিত্যের শিল্পিত রূপের প্রতিনিধিত্ব করছে। লোকসাহিত্যের অন্য শাখার মতো চাটগাঁইয়া প্রবাদেও মানুষ, সমাজ ও পরিবেশের কথা অনিবার্যভাবে এসেছে। এগুলো এখন বাংলাসাহিত্যের নিজস্ব সম্পদ এবং ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত। শুদ্ধ অন্তঃপুরবাসিনী গৃহকর্ত্রী থেকে, খেটে খাওয়া-পরিশ্রমী শ্রমজীবী ও গ্রামীণ মানুষেরা রচনা করেছেন সরস ও সুতীব্র মন্তব্য আর তার থেকেই উদ্ভব হয়েছে প্রবাদ নামক লোক ঐতিহ্যের। প্রবাদ প্রতিটি ভাষার অমূল্য সম্পদ। বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি তথা সামগ্রিক জীবনাচরণে প্রবাদ সমৃদ্ধ একটি ধারা হিসেবে বিবেচিত। প্রবাদের মাধ্যমে বাঙালির জীবন, ধর্ম, সংস্কৃতি, আচার, বিশ্বাস ও রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। আর প্রবাদ বর্তমানে লোকসংস্কৃতি বা লোকসাহিত্য বা মৌখিক সাহিত্যেরও একটি জনপ্রিয় শাখায় পরিণত হয়েছে। প্রবাদবাক্য গোষ্ঠী-মানুষের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার দ্বারা রচিত। গোষ্ঠীগত রচনা তাই অঞ্চলভেদে ভাষা ও শব্দে বদলে যেতে পারে প্রবাদ বাক্যে। ‘প্রবাদে’ দু’চারটে শব্দের মধ্যে দিয়ে বক্তব্য এলেও তা অনেক গ্রহণযোগ্য এবং হৃদয়গ্রাহী হয়। প্রবাদের মধ্যে থাকে যুগ-যুগ ধরে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা আর মানবিক আবেদন। সহজ প্রকাশভঙ্গি আর সরল ও সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনায় তা হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। আর চট্টগ্রামের প্রবাদসমূহ হৃদয় থেকে উৎসারিত কথামালার সরস বয়ান। লোক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে চাটগাঁইয়া প্রবাদের গবেষণা, বিকাশ ও সংরক্ষণে আমাদের যত্নবান হতে হবে।