চাঁদের মাটিতে নেমে ইতিহাস গড়ল ভারত

সুপ্রভাত ডেস্ক »

চাঁদের যে অংশে এতদিন পৌঁছাতে পারেনি কেউ, যা নিয়ে বিজ্ঞানীদের ধারণাও সীমিত, পৃথিবীর উপগ্রহটির খানাখন্দে ভরা আবছায়া সেই দক্ষিণ মেরুতে প্রথম আলো ফেলে ইতিহাস গড়ল ভারত।

বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে কোনো মহাকাশযানের সফট ল্যান্ডিং করাতে সক্ষম হয়েছে দেশটি। স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে চাঁদের মাটি স্পর্শ করে চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডার বিক্রম। খবর বিডিনিউজের।

স্মরণীয় এই অভিযানে চাঁদের মাটিতে অবতরণের সঙ্গে সঙ্গেই কন্ট্রোল রুমে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর কর্মকর্তারারা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন।

ইসরো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে (টুইটার) লেখে, চন্দ্রযান-৩ মিশন: ভারত, আমি আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেছি এবং আপনিও। চন্দ্রযান-৩ সফলভাবে চাঁদে সফট ল্যান্ডিং করেছে। অভিনন্দন ভারত।

ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন তিনি। ইতিহাস জয়ে ভারতবাসীর সঙ্গে উচ্ছ্বসিত ছিলেন তিনিও।

চাঁদের মাটিতে সফলভাবে ভারতের চন্দ্রযানের অবতরণের পর মোদী বলেন, আমি হয়ত দক্ষিণ আফ্রিকায় আছি, তবে আমার মনটা চন্দ্রযান মিশনের সঙ্গেই আছে। আমরা নতুন ভারতের নতুন যাত্রার সাক্ষী। নতুন ইতিহাস লেখা হল।

কোনো দেশই সেখানে (চাঁদের দক্ষিণ মেরু) পৌঁছাতে পারেনি এর আগে। আমাদের বিজ্ঞানীদের কঠোর পরিশ্রমে আমরা সেখানে পৌঁছতে পেরেছি।
আকাশের কোনো সীমা নেই। এই মিশনের সফলতা ভারতকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে। এই দিনটি দেখাচ্ছে, কীভাবে আমরা ব্যর্থতা থেকে শিখে চূড়ান্ত সফলতা লাভ করি, বলেন মোদী।

চন্দ্রপৃষ্ঠে নামার ২০ মিনিটের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান শেষে চন্দ্রযান-৩ মিশনের প্রকল্প পরিচালক পি ভিরামুথুভেল বলেন, আমরা চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি যাওয়া প্রথম দেশ হয়েছি।

ইসরো প্রধান এস সোমানাথ চন্দ্রযান-৩ মিশনের সাফল্যে তার টিমকে অভিনন্দন জানান।

চাঁদের দক্ষিণ মেরু নিয়ে রহস্য দীর্ঘদিনের। এর আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন চাঁদে নভোযান পাঠাতে সক্ষম হলেও এই অংশে কেউই পোঁছাতে পারেনি।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, ওই অঞ্চলে পানির সন্ধান মিলতে পারে, খুঁজে পাওয়া যেতে প্রাণের অস্তিত্ব।

ভারতের মহাকাশযানের ল্যান্ডার বিক্রম থেকে বের হয়ে রোবটযান প্রজ্ঞান সেগুলোই সন্ধান করবে, চন্দ্রপৃষ্ঠের রাসায়নিক গঠন বিশ্লেষণ করে পৃথিবীতে ছবি আর তথ্য পাঠাবে। খুলবে মহাকাশ নিয়ে গবেষণার নতুন দুয়ার।

চাঁদের দক্ষিণ মেরু জয়ের যাত্রা যে সহজ নয়, সে বিষয়টিরও বিজ্ঞানীদের অজানা নয়। গত ১৪ জুলাই দুপুরে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে চন্দ্রযান-৩ এর সফল উৎক্ষেপণ করে ইসরো। এরপর রাশিয়াও চাঁদের ওই ‍অঞ্চলে যাত্রা করে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চন্দ্রপৃষ্ঠে আছড়ে পড়ে দেশটির ‘লুনা ২৫’ নভোযান। প্রায় অর্ধ শতাব্দির মধ্যে চাঁদের উদ্দেশে পাড়ি জমানোয় দেশটির প্রথম উদ্যোগ ছিল সেটি।
১৯ থেকে ২১ অগাস্টের মধ্যে লুনা ২৫ নভোযানটির চাঁদে অবতরণ করার কথা থাকলেও অবতরণের আগে গতিপথ বদলাতে গিয়ে সমস্যায় পড়ার কথা জানায় রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা কর্তৃপক্ষ রসকসমস।

চন্দ্রযান-৩ এর মিশন শুরু হয়েছিল অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে।

এর আগে ২০১৯ সালে চাঁদের এই অংশে পৌঁছাতে চন্দ্রযান-২ উৎক্ষেপণ করেছিল ভারত। ওই অভিযান আংশিকভাবে সফল হয়েছিল। চন্দ্রযান-২ এর অরবিটার আজও চাঁদের চারপাশ প্রদক্ষিণ করছে এবং তথ্য পাঠাচ্ছে। কিন্তু এর ল্যান্ডার অবতরণের সময় শেষ মুহূর্তের জটিলতায় চাঁদের মাটিতে বিধ্বস্ত হয়।

চন্দ্রযান-২ যেসব সমস্যায় পড়েছিল, সেগুলো ঠিকঠাক করেই চন্দ্রযান-৩ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করে ভারত। ফলে এবার প্রত্যাশা ও আত্মবিশ্বাস অনেক বেশিই ছিল। সেই আত্মবিশ্বাসই ভারতকে বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে চাঁদের মাটিতে নামার কৃতিত্বের অধিকারী করে দিল।
চাঁদে পৌঁছানোর চেষ্টায় এর আগে দুটো অভিযান চালিয়েছে ভারত।

২০০৮ সালে প্রথম অভিযানে চন্দ্রযান-১ পৌঁছেছিল চাঁদের কক্ষপথে। চাঁদের ভূপৃষ্ঠের গঠন ও পানির উপস্থিতি নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণা চালানো হয় সে সময়। দিনের বেলায় চাঁদে যে একটি বায়ুম-ল সক্রিয় থাকে, ওই গবেষণাতেই তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।

২০১৯ সালের দ্বিতীয় অভিযান আংশিকভাবে সফল হয়েছিল। চন্দ্রযান-২ এর অরবিটার আজও চাঁদের চারপাশ প্রদক্ষিণ করছে এবং তথ্য পাঠাচ্ছে। কিন্তু এর ল্যান্ডার অবতরণের সময় শেষ মুহূর্তের জটিলতায় চাঁদের মাটিতে বিধ্বস্ত হয়।

ইসরোর প্রধান শ্রীধরা পানিকার সোমানাথ বলেন, আগের অভিযানের তথ্য তারা খুব সতর্কতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করে এবারের অভিযানের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন, যাতে চন্দ্রযান-৩ কোনো জটিলতায় না পড়ে।

চাঁদের দক্ষিণ মেরু নিয়ে মানুষের গবেষণা খুব বেশি এগোয়নি। ছায়ায় ঢাকা ওই অঞ্চল চাঁদের উত্তর মেরুর চেয়ে অনেকটা বড়। ধারণা করা হয়, সবসময় অন্ধকারে থাকা ওই অঞ্চলে বরফ বা পানির অস্তিত্ব থাকলেও থাকতে পারে। এই বরফ বা পানি খোঁজাই ভারতের এবারের চন্দ্রাভিযানের মূললক্ষ্য।

অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে চন্দ্রযান-৩ এর সফল উৎক্ষেপণ যাত্রার ঐতিহাসিক সেই মুহূর্তের সাক্ষী হতে ভারতের শতকোটি মানুষের চোখ ছিল টেলিভিশন আর সোশাল মিডিয়ায়। আগ্রহ নিয়ে নজর রাখেন বিশ্বের অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানীরাও।

পৃথিবী থেকে চন্দ্রযান-৩ এর চাঁদে পৌছতে সময় লাগে ৪০ দিন। গত ১৭ অগাস্ট বৃহস্পতিবার চন্দ্রযান-৩ এর ‘প্রপালশন মডিউল’ থেকে ‘ল্যান্ডার মডিউলটি’ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পৃথিবী থেকে সমস্ত পথ ল্যান্ডারকে বয়ে নিয়ে এসেছে প্রপালশন মডিউল।

এরপর ২২তম দিনে অর্থাৎ গত ৫ অগাস্ট সেটি চাঁদের কক্ষপথে ঢুকে পড়ে। পরে চন্দ্রযানটির দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত ডি-বুস্টিং অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয় ওইদিন সকালে। সেসময় চাঁদের কক্ষপথের এমন একটি অবস্থানে এই মহাকাশ যানটি অবস্থান করছিল, যেখান থেকে চাঁদের নিকটতম দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার এবং দূরবর্তী পথের দূরত্ব ১৩৪ কিলোমিটার।

ইসরো তখন জানায়, দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত ডিবুস্টিং অপারেশনের মধ্য দিয়ে লুনার মডিউল সফলভাবে কক্ষপথের দূরত্ব কমিয়ে এনেছে। মডিউলটি অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাবে এবং নির্ধারিত ল্যান্ডিং সাইটের সূর্যোদয়ের জন্য অপেক্ষা করবে।

চাঁদের কক্ষপথে এসে ইতোমধ্যে বেশকিছু ছবিও পাঠিয়েছে চন্দ্রযান-৩। ইসরোর বিজ্ঞানীরাও জানাচ্ছিলেন, সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছে। সবকিছু তারা পরীক্ষা করে দেখছেন।

চন্দ্রযান-৩ এর তোলা বেশ কিছু ছবিতে দেখা গেছে বিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত খানাখন্দ। এই ছবিগুলো তুলেছে নভোযানটির এলপিবিসি। বিক্রমের জন্য খানাখন্দ ও বোল্ডার এড়িয়ে নিরাপদ অবতরণ এলাকা খুঁজে বের করতে সহায়তা করা এলপিবিসির প্রধান কাজ।

চন্দ্রযান-৩ এর ওজন ৩ হাজার ৯০০ কেজি, যা বানাতে খরচ হয়েছে ৬.১ বিলিয়ন রুপি (সাড়ে ৭ কোটি ডলার)। চন্দ্রযান-২ এর মত এই মহাকাশযানটিও তৈরি হয়েছে অরবিটার, ল্যান্ডার ও রোভার- এই তিনটি অংশ নিয়ে।

ইসরোর প্রতিষ্ঠাতার নামে চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডারের নাম রাখা হয়েছে বিক্রম, যার ওজন দেড় হাজার কেজি। ওই বিক্রমই তার পেটের মধ্যে বহন করে ২৬ কেজি ওজনের রোভার বা রোবটযান প্রজ্ঞানকে।

ল্যান্ডার বিক্রমের অবতরণের সময়টা হতে হয় একেবারে নির্দিষ্ট, চাঁদের কোনো এক দিনের ঠিক সূচনায়। কারণ ল্যান্ডার আর রোভারের ব্যাটারি চার্জ হতে সূর্যালোক দরকার হবে।

এই রোভার সক্রিয় থাকবে চাঁদের এক দিন, যা পৃথিবীর ১৪ দিনের সমান। ২৮ দিনে এক চান্দ্রমাসের বাকি ১৪ দিন থাকে টানা অন্ধকার বা রাত। ফলে টানা ১৪ দিনের সময়টাতেই চাঁদের মাটিতে ঘুরে বেড়াবে প্রজ্ঞান।