অধ্যাপক জাহাঙ্গীর চৌধুরী »
ডায়াবেটিসের বিশ্বায়ন: বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস মহামারী আকার ধারণ করেছে। রোগের ব্যাপকতা উপলব্ধি করে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯৭ সালে ডায়াবেটিস রোগটিকে মহামারী হিসাবে ঘোষণা করে। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের (আই.ডি.এফ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে সারা পৃথিবীতে মোট ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৪ কোটি। এই সংখ্যা ২০৪৫ সালে ৭৮ কোটিতে পৌঁছাবে বলে আশংকা করা হয়েছে। আশংকার বিষয়, মোট রোগীর অর্ধেকই তার শরীরে যে ডায়াবেটিস আছে তা জানে না। ্এখানে উল্লেখ্য যে, উন্নত বিশ্বের দেশগুলির তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশেও ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। বর্তমানে ৮০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীই বসবাস করে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। দ্রুত নগরায়ন ও জীবনযাপনে পরিবর্তন এর অন্যতম কারন হিসাবে দেখা হয়ে থাকে। ডায়াবেটিস মহামারী প্রতিরোধে সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ‘ইউনাইটস ফর ডায়াবেটিস‘ নামে একটি ঘোষনা গৃহীত হওয়ার পাশাপাশি ১৪ নভেম্বরকে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
ডায়াবেটিস ও বাংলাদেশ ঃ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ডায়াবেটিস ও অন্যান্য অসংক্রামক রোগসমূহ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আই.ডি.এফ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৩১ লক্ষ। ধারণা করা হচ্ছে ২০৪৫ সালে রোগীর সংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এনসিডি স্টেপ সার্ভে ২০২২-২৩ এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি দশজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ডায়াবেটিস সমিতির তথ্য মতে, এই সংখ্যা প্রতি পাঁচজনে একজন। সমিতির গবেষনা বলছে, চারজন নারীর মধ্যে একজন গর্ভকালিন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে, পনের শতাংশ নারী এক বছরের মধ্যেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। শুধু প্রাপ্তবয়স্ক মানুষরাই না, শিশুদের মধ্যেও বাড়ছে ডায়াবেটিস। ১৫-২০ বয়সি শিশুদের মধ্যে আক্রান্তের হার ৪.৪ শতাংশ। আশংকার কথা, আক্রান্তদের অর্ধেকের বেশি তাদের রোগ সর্ম্পকে অবগত নন। উপসর্গ না থাকায় বেশিরভাগ মানুষ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করান না ফলে দেরিতে ডায়াবেটিস সনাক্ত হওয়ায় ৫০-৬০ শতাংশের ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা নিয়ে সনাক্ত হন। গবেষণা বলছে, ডায়াবেটিস আক্রান্তদের মধ্যে শুধুমাত্র ২০ শতাংশের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। যার ফলে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা বিশেষ করে চোখ, কিডনি, হার্ট, ¯œায়ুর রোগ দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশের স্বাস্থ্যখাতে। উদ্বেগের বিষয় হলো, বাংলাদেশের সীমিত স্বাস্থ্যবাজেট দিয়ে ভবিষ্যতে এই বিপুল পরিমাণ ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসা সেবা দেয়া সত্যিকার অর্থে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
দেশীয় গবেষণালব্ধ ফল ঃ ডায়াবেটিস যেহেতু সারা জীবনের রোগ তাই সারা জীবন একজন ডায়াবেটিস রোগীকে বিভিন্নভাবে রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে হয়, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমানিত হয়েছে যে, সনাক্তের ১০-১২ বৎসর পূর্বেই শরীরে ডায়াবেটিস, মূলত টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগ সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে থাকে এবং ঝুঁিকপূর্ণ অবস্থায় সনাক্ত করা গেলে ৬০-৭০ ভাগ ক্ষেত্রে টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। ফিনল্যান্ড, চীন, ভারত ও আমেরিকায় পরিচালিত গবেষণার মত বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি পরিচালিত ডায়াবেটিস প্রতিরোধ বিষয়ক গবেষণায় প্রি-ডায়াবেটিস সনাক্ত মানুষদের শুধুমাত্র জীবনযাপনে শৃঙ্খলা ও পরির্বতনের মাধ্যমে ৬০ শতাংশ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে।
ডায়াবেটিস ও শেখ হাসিনা ঃ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ৭৫তম জন্মদিন ও বাংলাদেশের ৫০ বছর উদ্যাপন উপলক্ষে স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি যৌথভাবে “কান্ট্রি চেঞ্জিং ডায়াবেটিস” নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন, জাইকা ও আইএফআইসি ব্যাংক এর পাশাপাশি বেশ কিছু দেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সহযোগীতা করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন কর্তৃক ১ম গ্লোবাল অ্যাম্বাসেডর ফর ডায়াবেটিস মনোনীত হওয়ায় প্রকল্পটির গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। ফলশ্রুতিতে ডায়াবেটিস ও এর জটিলতা হ্রাস বিষয়ক নাগরিক সচেতনতা তৈরীতে যেমন ভূমিকা রাখবে তেমনি সরকারের এসডিজি (৩ ও ১১) লক্ষ্য পূরণে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখবে। অতি সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সদাশয় সরকার, স্বাস্থ্যবান্ধব সরকার বিধায় গরীব রোগীদের বিনামূল্যে ইনসুলিন দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছেন কম্যুনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার এই মহতী উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক আবিষ্কার : দিন দিন ডায়াবেটিক রোগ এবং রোগী যেমন বাড়ছে তেমনি দিন দিন পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের (IDF) তত্ত্বাবধানে অনেক বিজ্ঞানী অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল হিসাবে ঔষধ এবং ইনসুলিনের উন্নয়নের বিভিন্ন টেস্ট বা পরীক্ষার বেলায়ও গবেষণা চলমান আছে। সম্প্রতি একটি গবেষণা জানাচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা A.I (Artificial Intelligence) টাইপ ২ ডায়াবেটিস সনাক্ত করতে পারে। গলার স্বর শুনেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে বলে দেওয়া সম্ভব যে, শরীরে ডায়াবেটিস বাসা বেঁধেছে কি না। মায়ো ক্লিনিকের ”ডিজিটাল হেলথ” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এই সমীক্ষা। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এত সহজে ডায়াবেটিস নির্ণয়ের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই শুরু হয়েছে চর্চা। এই সমীক্ষার আয়োজক কমিটিতে থাকা গবেষক ইয়ান ফোসাট জানাচ্ছেন, স্বর শুনে ডায়াবেটিস চিহ্নিত করার এই প্রযুক্তি নবজাগরণের মতো। ফলশ্রুতিতে রক্ত পরীক্ষার জন্য ফোঁড়াফুঁড়ির কষ্ট থেকে রোগীরা পরিত্রাণ পাবে।
যেহেতু ডায়াবেটিস অনিরাময়যোগ্য ও আমৃত্যু এই রোগের চিকিৎসা সেবা একজন রোগীকে গ্রহণ করতে হয়, সেহেতু চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল তুলনামূলক কম খরচে রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা সেবা প্রদান করে যাতে ডায়াবেটিস চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীদের জীবন জীবিকায় কোন প্রভাব না পড়ে। আসুন এবারের বিশ^ ডায়াবেটিস দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়কে ধারণ করে আমরা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে সদা সচেষ্ট থাকি পাশাপাশি প্রতিকার ও প্রতিরোধে সবাই মিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিই। চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালে ডায়াবেটিক ও নন-ডায়াবেটিক সকল রোগীদের জন্য সমানভাবে চিকিৎসা সেবা চলমান রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে সুলভমূল্যে সকল চিকিৎসা সেবা পেতে ডায়াবেটিক হাসপাতালে আসুন, চিকিৎসা নিন, সুস্থ থাকুন।
সভাপতি, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল