রাজিব শর্মা »
নগরীর পাথরঘাটা থেকে বকশিরহাটে বাজার করতে আসেন আগ্রাবাদের একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এল ডায়েস। তিনি সুপ্রভাতকে বলেন, ‘দেশ এখন অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি। সাধারণ মানুষদের করার কিছু নেই। ব্যবসায়ীরা এখন আর সরকারের নির্দেশনাও মানছে না। বাজার করতে এলে খুচরা বিক্রেতারা বলে পাইকারেরা আর পাইকারেরা বলে উৎপাদকেরা বাড়াচ্ছে।’
ডায়েস বলেন, ‘গত এক সপ্তাহ ধরে অস্থির হওয়া সবজি-আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিকার বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছে। কিন্তু অভিযানে সবজি আলুর বাজারে ইতিবাচক কোন প্রভাব পড়েনি। একসময় দেখা যাবে ব্যবসায়ীরা এ সংস্থাটিকেও আর কোন মূল্যায়নও করছে না।’
একই বাজারে কথা হয় মো. ফোরকান আলী নামের এক রিকশাচালকের সঙ্গে। সবজির চড়া দামে ক্ষুব্ধ ফোরকান আলী বলেন, ‘একটি সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করতাম। করোনাতে তা চলে যায়। এরপর থেকে রিকশা চালাচ্ছি। পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে বস্তিতে কোনমতে দিন কাটাচ্ছি। দিনে আয় হয় চার থেকে পাঁচশো টাকা। তিন ছেলেমেয়ে পড়ালেখা করে। বাজারে কোন মাছই ২৫০ টাকার নিচে নেই। গোশত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি অনেক আগে। সবজির বাজারে এসে দেখি ৭০ থেকে ১০০ টাকার নিচে কোন সবজিই নেই। ৪৫ থেকে ৫০ টাকা আলু। আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খাবো তার কোন জোগান নেই।’
একই বাজারে কথা হয় মাধ্যমিক শিক্ষিকা তসলিমা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এক কেজি বরবটি ১০০ টাকা। এক কেজি মাছ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এই চড়া দামের পরও যারা বলে বাজার নিয়ন্ত্রণে আছে, এক কথায় বলবো বাজার নিয়ে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে তারা নিজেরাই নিয়ন্ত্রণে আছে।’
ডায়েস, তসলিমার মতো অনেক নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দামে পরিবার নিয়ে চিন্তিত। তাদের দাবি, বাজার তদারকিতে ওপর মহলের অবহেলা রয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করার সুযোগ পাচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) নগরীর রেয়াজউদ্দিন, বকশিরহাটসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে ক্রেতাদের এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। বাজারে দেখা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে পেঁয়াজ, ডিম ও আলুর দর নির্ধারণ করার এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও তার কোন ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। বরং আগের মতো চড়াদামে বিক্রি করছে ব্যবসায়ীরা।
ব্রয়লার, সোনালি মুরগি ও মাছের দাম গত সপ্তাহের চেয়ে আরো বেড়েছে। সমুদ্রের মাছ ও সবজির যোগান ভালো থাকা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা চড়া দামে বিক্রি করছে। তাছাড়া আদা ও রসুনের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখনো চড়া রয়েছে।
মাত্র একদিনের ব্যবধানে বাজারে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। ২০০ টাকা কেজির কমে মিলছে না ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের আদা। সপ্তাহের ব্যবধানে আমদানি করা রসুনের দাম কেজিপ্রতি ৪০ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২২০ টাকায়।
বিক্রেতারা এসব পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে আমদানি জটিলতা, পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীদের বাড়তি দরসহ নানা ধরনের সংকটের কথা বলেন।
অন্যদিকে সবজির বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সপ্তাহের ব্যবধানে কোনো সবজির দাম কমেনি। বরং এ বছর চড়া দামের সবজির তালিকায় যোগ হয়েছে সচরাচর স্থিতিশীল থাকা আলুও। সপ্তাহ ধরে আলুর বাজারকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলেও তার কোন প্রভাব বাজারে পড়েনি। এখন অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বাড়তি দামে আলু কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
গতকাল বাজারে মুন্সীগঞ্জের আলু বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে আলুর দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ১৫ টাকা। গতবছর এদিনে আলু বিক্রি হয়েছিল ২৩ থেকে ৩০ টাকা। যা বছরের ব্যবধানে বেড়েছে দ্বিগুণ। শুধু আলু নয়, বাজারে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠেছে বরবটি, কাকরোল, তিতা করলা, কচুমুখির দামও। সারাবছর এসব সবজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে কেনা গেলেও এসব সবজি এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাজারে অন্যান্য সবজিও প্রতি কেজি ৬০ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে।
বকশিরহাটের আলু ব্যবসায়ী শিমুল বলেন, খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা চড়া দামে আলু বিক্রি করছে। আজকে আমি কিনেছি কেজি ৩৭ টাকা করে। তার মধ্যে অনেক আলু পঁচা। যা সবকিছু মিলিয়ে ৪৫ টাকা করে বিক্রি করছি।
সবজির পাশাপাশি বেশ উত্তাপ ছড়াচ্ছে মাছের বাজারও। বাজারে আধাকেজি ওজনের বেশি ইলিশের দাম ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। এক কেজি বা তার বেশি ওজনের ইলিশের দর ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা। দুই কেজি ওজনের রুই মাছের দর ৩২০ থেকে ৩৬০ টাকা। কতলা মাছের কেজি ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা। বড় সাইজের চিংড়ি ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা। পোয়া ৩২০-৩৬০ টাকা, ছোট সাইজের রূপচান্দা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, আর পাঙ্গাস ও লইট্যা ২২০ থেকে ২৫০ টাকা ।
মুদি দোকানগুলোতে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৭৫ টাকা ও চিনি ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে চিনির সংকট কাটেনি। অধিকাংশ দোকানে এখনো পাওয়া যাচ্ছে না প্যাকেটজাত চিনি।
এছাড়া সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ১৫ টাকা বেড়ে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা, সোনালি মুরগি ৩০০ থেকে ৩৪০ টাকা আর দেশী মুরগি ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। কমতিতে নেই গরু ও খাসির মাংসের দামও। বর্তমানে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ৯৫০ টাকা ও খাসি সাড়ে ১১শ টাকা কেজি।
মুরগিবিক্রেতারা বলেন, ফার্মে মুরগি উৎপাদনে সংকট রয়েছে। দাম কমার তেমন আশা নেই।
এছাড়া চড়া বাজারে অস্থির হওয়া ডিমের বাজার এখনো রয়েছে স্থিতিতে। মধ্যবিত্ত পরিবার মাছ-মাংসের চাহিদা কমিয়ে ডিমের ওপর নির্ভর করলেও এখন সেখানেও মূল্যবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। বাজারে ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ডজনপ্রতি ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকায়। আর হাঁসের ডিম এখনো ডাবল সেঞ্চুরিতে।
পোলট্রি খাদ্যের দাম না কমলে দেশীয় খামারে উৎপাদিত মুরগীর ডিমের দাম কমবে না বলে আশঙ্কা করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।
বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও বেশিরভাগ মানুষের আয় সে অনুযায়ী বাড়েনি। নতুন করে যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলছে, এটা যদি এভাবেই চলতে থাকে তাহলে আগামীতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।