খুলবে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দুয়ার
ভূঁইয়া নজরুল »
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেলের বোরিং কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের গণমানুষের নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীকে স্মরণ করে আবেগতারিত কন্ঠে বলেছিলেন, ‘কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণের জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী আন্দোলন পর্যন্ত করেছিলেন। তিনি কর্ণফুলীতে পিলার সেতুর বিরোধী ছিলেন। যদি পিলার সেতু নির্মিত হয় তাহলে কর্ণফুলীতে পলি জমে চট্টগ্রাম বন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তার চিন্তা অমূলক ছিল না। তিনি খুব দূরদর্শী ছিলেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী বেঁচে তাকলে খুশি হতেন। দুঃখের বিষয় তিনি তা দেখে যেতে পারলেন না।’
মহিউদ্দিন চৌধুরী যে সঠিক চিন্তা করেছেন আজ সেটাই প্রমাণ হচ্ছে এই টানেলের মাধ্যমে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশের ৩২ দশমিক ৫ মিটার নিচ দিয়ে নির্মাণাধীন এই টানেল নদীর পানি প্রবাহে কোনো বাধা হবে না উল্লেখ করে টানেল প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর ও কর্ণফুলীকে বাঁচাতেই এই টানেল। এর মাধ্যমে দেশের পূর্বপ্রান্ত তথা কক্সবাজারের সাথে চট্টগ্রাম অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থায় যেমন গতি আসবে তেমনিভাবে আগামীতে মিয়ানমার হয়ে চীন পর্যন্ত যাতায়াতের ক্ষেত্রেও এই টানেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
এদিকে টানেলকে আরো ফলপ্রসু করে গড়ে তুলতে মিরসরাই থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগরপার হয়ে সুদীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। ইতিমধ্যে মিরসরাই ইকোনমিক জোন থেকে সুপার ডাইক নামে একটি প্রকল্পের কাজও শুরু হয়েছে। মিরসরাই অংশে তিন কিলোমিটার পর্যন্ত কাজ শেষ করার পর এখন সীতাকু- হয়ে ফৌজদারহাট পর্যন্ত নির্মাণের কাজ চলছে। এর নির্মাণকাজ শেষ হলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) আউটার রিং রোড হয়ে টানেল হয়ে গাড়ি সহজেই কক্সবাজারের দিকে চলে যেতে পারবে। একই পরিকল্পনায় কক্সবাজার পর্যন্ত সড়কটিকে চার লেনে উন্নীতকরণের কাজও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এবিষয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের নির্বাহি প্রকৌশলী জুলফিকার আহমেদ বলেন, ‘মিরসরাই জোরারগঞ্জ থেকে সাগরপার দিয়ে টানেল হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সমীক্ষা চলছে। সমীক্ষা শেষে অর্থায়ন কে করবে তা নিশ্চিত করা হবে। আর এর পরই প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হবে।’
কিন্তু টানেলের সাথে কক্সবাজার যাতায়াতের সংযোগ কীভাবে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টানেলটি যুক্ত হবে পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী সড়কের চাতুরী চৌমুহনী পয়েন্টে। সেখান থেকে একটি অংশ বর্তমান রোড দিয়ে চলে আসবে মইজ্যারটেক ওয়াই জংশনে এবং অপর অংশটি আনোয়ারার ভেতর দিয়ে বিদ্যমান দুই লেনের রোড হয়ে পটিয়া বাইপাসে এসে যুক্ত হবে।’
তিনি আরো বলেন, ওয়াই জংশনের দিকে আসার সময় রোডটি এখন দুই লেনের আছে, এটি চার লেনে উন্নীত করা হবে। আর পটিয়া বাইপাসের দিকে যাওয়ার রোডটি হবে দুই লেনের।
কক্সবাজার পর্যন্ত রোডটি চার লেনের হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কক্সবাজার পর্যন্ত রোডটি চার লেনে উন্নীতকরণের বিষয়ে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। কিন্তু এখনো প্রকল্প নেয়া হয়নি। তবে জাপান এই প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহী।’
এদিকে গত মঙ্গলবার সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, প্রকল্প এলাকায় তেমন কর্মচাঞ্চল্য নেই। এমনকি যে প্রান্ত দিয়ে টিউবটি স্থাপন করা হয়েছে সেখানেও তেমন কার্যক্রম নেই। এর কারণ জানতে চাইলে প্রকল্প এলাকায় নিয়োজিত উপপ্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘একটি টিউব স্থাপনের পর কাজ বন্ধ রয়েছে। কিছুদিন পর আরেকটি টিউবের কাজ শুরু হবে।’ তবে টানেলের পূর্ব প্রান্তে এপ্রোচ রোড নির্মাণের কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। সেখানে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের কাজ চলছে।
এদিকে টানেলের মুখে একদিকে রয়েছে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে প্রবেশের রাস্তা। এছাড়া একটি জায়গায় এসে মিলিত হয়েছে সাগরপারের আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, এবং বিমানবন্দরে যাওয়ার রোড। সব মিলিয়ে বহুমুখী ট্রাফিকের এক সংযোগস্থল। এবিষয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আমরা টানেল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে একটি সমন্বিত ডিজাইন করেছি। সেই ডিজাইনে এলিভেটেডের টোল প্লাজা রাস্তায় না ফ্লাইওভারের উপরে রাখতে সুপারিশ করা হয়েছে। একইভাবে আউটার রিং রোডের সাথেও সামঞ্জস্য রাখা হয়েছে।’
চীনের সাংহাই নগরীর ওয়ান সিটি টু টাউনের আদলে আগামীতে বেড়ে উঠবে চট্টগ্রাম এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘একদিকে মিরসরাই ইকোনমিক জোন, বে টার্মিনাল এবং নদীর ওপারে চীনের ইকোনমিক জোন, মাতারবাড়ি বন্দর, পর্যটন শহর কক্সবাজারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবে এই টানেল।’
উল্লেখ্য, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের জন্য ২০১৭ সালে প্রকল্প অনুমোদন পায়। ব্রিজ নির্মাণ করলে কর্ণফুলী নদীতে পলি জমে নাব্যতা নষ্ট হতে পারে সেই শঙ্কায় নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের প্রকল্প নেয়া হয়। চীনের এক্সিক ব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থায়ন করে। প্রকল্পের ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকার মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক অর্থায়ন করবে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার অর্থায়ন করবে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। পতেঙ্গার নেভাল পয়েন্ট দিয়ে টানেল শুরু হয়ে নদীর ওপারে সিইউএফএল পয়েন্টে গিয়ে উঠবে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে দুই টিউবের এই টানেল নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।