ক্ষণিকের আপন

নূর নবী আহমেদ »

মোহনগঞ্জ রেলস্টেশনে একাকী হাঁটছি, কী একটা বিষয় নিয়ে ভাবছি। অনেকটা সময় হাঁটার পর একটা চা’র স্টলে বসি। চা’স্টল থেকে বের হয়েই আলামিনের সাথে দেখা হয়ে যায়। মোটামুটি যথেষ্ট দিন পর আমাদের দেখা হয়। আমি আর আলামিন স্টেশনের দক্ষিণ প্রান্তের বড় রেইনট্রিটার নিচে দাঁড়িয়ে কথা শুরু করি। স্টেশনের বৈদ্যুতিক আলোর কিঞ্চিৎ পরিমাণ এখানে পড়েছে। সময় রাত আটটা। রাতের ট্রেন আসতে আরো এক ঘণ্টা আছে। আলামিনের সাথে আমার আলাপ জমে ওঠে।
আসসালামু আলাইকুম বলে আমাদের কথার মাঝে একজন সালাম দেয়। আমরা দুজন তখন হাসছিলাম। হাসি বন্ধ করি।
লোকটি আমাদের প্রশ্ন করে, আপনাদের বাড়ি কি এখানে?
আলামিন বলে, আমার বাড়ি এখানে না। আমাকে ইঙ্গিত করেÑÑ ওর বাসা এখানে।
লোকটির সাথে আমাদের কথা শুরু হয়। উনি বলেন, আমার নাম লুৎফর রহমান, বাড়ি পঞ্চগড়। আমি আসছিলাম ধরমপাশায় একজনের কাছে।
আলামিন বলে, এখন কি পঞ্চগড় যাবেন?
হ্যাঁ
আমারও তাঁকে জানতে আগ্রহ হলো। প্রশ্ন করি। উনিও বলেন আমরা শুনি।
বাবারা একটা কথা বলি, যদিও বলতে লজ্জা করছে।
আমি বলি, সমস্যা নেই। বলুন, চাচা।
উনি পুনরায় উল্লেখ করেন, আমার বলতে লজ্জা করছে।
আমি অনুভব করি, একটা আত্মসম্মানবোধের কাঁটা এসে তাঁকে বিঁধছে। বলে রাখা ভালো যে, উনার বাচনভঙ্গি সুন্দর। যাতে তাঁর ব্যক্তিত্ব উজ্জ্বলভাবে সৌরভ ছড়াচ্ছে।
আমার হাতে কোনো টাকা-পয়সা নাই। আপনারা যদি একটু সহযোগিতা করেন।
আমার আর আলামিনে অবস্থা একই। বাড়ি থেকে যা পাই কোনো মতে চলে।
আমি বলি, আমার কাছে মাত্র বিশ টাকা আছে।
উনি চুপ থাকেন। আমি উনার মুখের দিকে তাকাই। আমার ইচ্ছে হয়, মোহনগঞ্জ নামক শহরটা বিক্রি করে লুৎফর নামক পঞ্চগড়ের সহজ-সরল মানুষটার ভাড়ার টাকা দিই। কিন্তু সেই ক্ষমতা আমার নেই।
আমি ও আলামিন দুজনের পকেটে মোট তেতাল্লিশ টাকা খুঁজে টাকা পাই। তাঁর হাতে দিই। আমার আগ্রহ জাগে উনার ঠিকানাটা জানতে। আমি তা বলি, উনি দিতে রাজি হন। চায়ের স্টল থেকে একটা কলম আর ছেঁড়া শাদা পৃষ্ঠা নিয়ে আসি। লুৎফর চাচা নিজের ঠিকানা লিখে দেন। আমার মোবাইল নাম্বার লিখে দিই। এসব ব্যাপারে আলামিনের তেমন আগ্রহ দেখা গেল না।
ট্রেনের হুইসেল শুনতে পাই আমরা। ট্রেন এসে স্টেশনে দাঁড়ায়। আলামিন ওঠে এক বগিতে। সে যাবে ময়মনসিংহ। লুৎফর চাচা ওঠেন অন্য বগিতে। লুৎফর চাচার সাথে কোনো লাগেজ নেই। আমি আলামিনের কাছ থেকে তাড়াতাড়ি বিদায় নিই। লুৎফর চাচা যে বগিতে ওঠেন আমি সেই বগিতে তার কাছে যাই। জানলা দিয়ে চাচার সাথে কথা বলি।
চাচা বাড়িতে পৌঁছে আমারে কল দেবেন। চাচীরে আমার সালাম দেবেন।
আচ্ছা বাবা।
আমি কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে আপনাদের পঞ্চগড়ে বেড়াতে যাবো।
পঞ্চগড়ে গেলে আমার বাড়িতে যাবেন।
চেষ্টা করবো।
গেলে অনেক খুশি হবো।
হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছাড়ে।
তারপর থেকে লুৎফর চাচার ফোনের অপেক্ষায় আছি। জানি তেতাল্লিশ টাকা দিয়ে কিছুই হবে না।
বছরটা পার হয়ে গেল। একদিনের জন্যও মোবাইলটা বন্ধ করিনি। কিন্তু লুৎফর চাচার কোনো ফোন এলো না।
লুৎফর চাচা আমাকে ও আমাদের ভুলে গেলেন? ভুলে গেলেন মোহনগঞ্জ রেলস্টেশন? আমি তো উনাকে ভুলিনি। নাকি চাচা এখনো পঞ্চগড়েই পৌঁছাননি? তাহলে কখন পৌঁছাবে? আমি কীভাবে তা জানতে পারবো!