‘ক্রসিং ভোগান্তি’ থেকে মুক্তি

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ

সুপ্রভাত ডেস্ক »

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে কুমিল্লার লাকসাম পর্যন্ত ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে নতুন যুগের সূচনা হল ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ডাবল লাইনে ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন করেন।

এর মাধ্যমে ৩২১ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের পুরো অংশ ডাবল লাইনে উন্নীত হল। এ পথে আর কোনো ট্রেনকে ক্রসিংয়ে পড়তে হবে না বলে কমে আসবে যাত্রার সময়।

কুমিল্লা থেকে আখাউড়া পর্যন্ত রেলপথ সিঙ্গেল লাইনের হওয়ায় এতদিন ক্রসিংয়ে পড়ে বিলম্বিত হত অনেক ট্রেনের যাত্রা। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকা ও সিলেটের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যেত। খবর বিডিনিউজের।

এই পথের বেশ কিছু ট্রেনের কয়েকদিনের চলাচলের সূচি ঘেটে দেখা যায়, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর চট্টলা এক্সপ্রেস ১৭ জুলাই নির্ধারিত সময় মেনেই কুমিল্লা পর্যন্ত আসে। কিন্তু এরপরই শুরু হয় বিলম্ব। নির্ধারিত সময় থেকে ৪০ মিনিটের বেশি দেরিতে ট্রেনটি আখাউড়া স্টেশনে যাত্রাবিরতি করে ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে ছেড়ে যায়।

ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস এবং নোয়াখালী থেকে ঢাকাগামী উপকূল এক্সপ্রেস প্রায় কাছাকাছি সময়ে আখাউড়া স্টেশনে ক্রসিংয়ে পড়ে। উপকূল এক্সপ্রেস আখাউড়া স্টেশনে যাত্রাবিরতি দেওয়ার পর বিরতীহীনভাবে যাবে সোনার বাংলা- এমনটাই নিয়ম।

তাতে ২০ থেকে ৪০ মিনিট খেসারত দিতে হত উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে। কোনো কারণে ৫ থেকে ১০ মিনিট দেরি হলে আখাউড়ায় না এনে কসবা কিংবা ইমামবাড়ি স্টেশনে বসিয়ে রাখা হত উপকুল এক্সপ্রেসকে। বিকেলে ঢাকা থেকে নোয়াখালী যাওয়ার পথেও ট্রেনটি একাধিক ট্রেনের সঙ্গে ক্রসিংয়ে পড়ত।

কেবল উপকূল বা চট্টলা এক্সপ্রেস নয়। আখাউড়া থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত চলতে গিয়ে অনেক ট্রেনই ক্রসিংয়ে পড়ে নির্ধারিত সময় মেনে চলতে পারত না। চট্টগ্রাম থেকে আসা বেশিরভাগ ট্রেনই সময় মেনে কুমিল্লা আসত। এরপর শুরু হত বিলম্ব। একইভাবে ঢাকা বা সিলেট থেকে আসা ট্রেনগুলো আখাউড়া পর্যন্ত সময় মেনে আসার পর বিলম্বিত হত।

আখাউড়া পৌর এলাকার রাধানগরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. ইয়াছিন চৌধুরী বলেন, পারিবারিক কাজে তিনি মাঝে মাঝে ফেনী যাতায়াত করেন। প্রতিবারই দেখা যেত আখাউড়া কিংবা ফেনীতে নির্ধারিত সময়ে ট্রেন চলে আসত। পরে কুমিল্লা-আখাউড়া অংশে ক্রসিংয়ের কারণে সব সময়ই ট্রেন বিলম্বিত হত।

ঢাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একই এলাকার পলাশ কুমার সাহা বলেন, ফেরার পথে ট্রেন ধরতে মেসেজের মাধ্যমে ট্রেনের অবস্থান জেনে বাড়ি থেকে বের হয়ে স্টেশনে আসতেন। প্রায়ই দেখা যেত কুমিল্লা পর্যন্ত তুর্ণা নিশিথা ট্রেন সময় মেনে এসেছে। এরপর আখাউড়া পর্যন্ত ৫০ মিনিটের পথ আসতে ক্রসিংয়ের কারণে ট্রেন দেড় থেকে পৌনে দুই ঘণ্টা সময় নিয়ে নিত।

এখন এই ৭২ কিলোমিটার রেলপথ ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন হওয়ায় পুরো ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে আর কোনো ট্রেনকে ক্রসিংয়ে পড়তে হবে না। ফলে অনির্ধারিত যাত্রা বিরতিতে সময়ও নষ্ট হবে না।

পাশাপাশি সারাদেশের রেললাইন ডুয়েল গেজ ডাবল লাইনে পরিণত করার পরিকল্পনাও একধাপ এগোবে। পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের রেলযোগাযোগ আরও সহজ হবে।

লাকসাম রেলওয়ে জংশনের সহকারী মাস্টার ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আখাউড়া-লাকসাম ডাবল লাইন রেলপথে ট্রেন চলাচল উদ্বোধন হওয়ায় রেলওয়েতে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হল।’

এ উপলক্ষে কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে স্টেশনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন তাতে অংশ নেন। গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আখাউড়া-লাকসাম রেল সেকশনের ডাবল লাইন উদ্বোধন করেন।

নতুন এ পথে মিটার গেজ ও ব্রড গেজ এ দুই ধরনের ট্রেনই চলাচল করতে পারবে। বর্তমানে এই পথে মোট ২৩ জোড়া ট্রেন চলাচল করে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে এ পথ দিয়ে ৭২ জোড়া ট্রেন চলাচলের সক্ষমতা তৈরি হবে। সেই সঙ্গে মালবাহী ট্রেন চলাচলের সক্ষমতাও কয়েক গুণ বাড়বে।

রেলওয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ১২৪ কিলোমিটার ব্রিটিশ আমলে ডাবল লাইনে উন্নীত হয়। লাকসাম থেকে চিনকি আস্তানা পর্যন্ত ৬১ কিলোমিটার ডাবল লাইন হয় ২০১৫ সালের এপ্রিলে। পরের বছরে ফেব্রুয়ারিতে টঙ্গী থেকে ভৈরববাজার পর্যন্ত ৬৪ কিলোমিটার ডাবল লাইন চালু হয়।

লাকসাম থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার রেলপথে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন করতে ২০১৪ সালে ছয় হাজার ৫০৪ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন হয় একনেকে। ২০১৬ সালের ১ নভেম্বর শুরু হয় নির্মাণ কাজ। ২০২২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা থেকে লাকসাম পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার অংশ ট্রেন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

ডাবল লাইন নির্মাণ এবং বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনের উন্নয়নে এ প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মধ্যে চার হাজার ১১৮ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এক হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ইউরোপীয় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক। আর এক হাজার ২৬ কোটি টাকার বেশি অর্থায়ন করেছে সরকার।

কুমিল্লার লাকসাম পৌর এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ডাবল লাইন হবে। অবশেষে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এখন থেকে আর ক্রসিংয়ের ঝামেলা পোহাতে হবে না। এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই।’