সুপ্রভাত ডেস্ক »
১৯৬০-এর দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই লেক খনন করার সময় চাকমা জনগোষ্ঠীর হাজার হাজার মানুষ ভারতের অরুণাচল প্রদেশে আশ্রয় নেয়। তাদের নিয়ে নতুন করে শুরু হয়েছে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক। শনিবার (২৯ জুলাই) ভারতের অরুণাচল প্রদেশ ও আসাম রাজ্যের দুটি অতি প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠনের যৌথ সম্মেলন থেকে তাদের বিতাড়িত করার দাবি তোলা হয়েছে।
অল অরুণাচল প্রদেশ স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আপসু) দাবি জানিয়েছে, অরুণাচলে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া যে চাকমারা ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে রয়েছে, তাদের দ্রুত রাজ্য থেকে বিতাড়িত করতে হবে। তবে অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়নও (আসু) এই দাবির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। তবে সেখানকার মানবাধিকার কর্মীদের অবশ্য পাল্টা দাবি, ‘চাকমারা কখনোই অরুণাচলে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নয়।’
ভারতে বসবাসকারী চাকমা জনগোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে, অরুণাচল প্রদেশে যে চাকমারা আছে, তারা মোটেও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নয় বরং আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে তখনকার ভারত সরকার এই শরণার্থীদের কৃষি ও বসতজমি দিয়ে অরুণাচলে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিল। আজ এত বছর বাদে তাদের ‘অবৈধ’ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টায় চাকমারা যথারীতি চরম ক্ষুব্ধ ও হতাশ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে হাজার হাজার চাকমা ভারতে এসেছিল ১৯৬২ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কমিশন করা কাপ্তাই লেকের জন্য ভিটেছাড়া হয়ে। খবর বাংলাট্রিবিউন।
গবেষকরা বলছেন, কাপ্তাই লেকের কারণে ৬৫৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়েছিল, যার মধ্যে ২২ হাজার হেক্টরই ছিল কৃষিজমি। এ সময় বাস্তুচ্যুত হয়েছিল প্রায় ১ লাখ উপজাতীয় লোকজন, যাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই ছিল চাকমা। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান শহর রাঙামাটির একটা বড় অংশ–যার মধ্যে চাকমা রাজাদের প্রাসাদও ছিল পুরোপুরি জলের তলায় চলে গিয়েছিল। এরপরই হাজার হাজার চাকমা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। যে কারণে চাকমারা অনেকেই আজও কাপ্তাইকে ‘কান্নার লেক’ বলে বর্ণনা করে থাকে।
ভারতে আসা এই চাকমা জনগোষ্ঠীর অনেকেই আর কখনও পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরে যায়নি। তাদের ধীরে ধীরে পুনর্বাসন করা হয়েছে ত্রিপুরা, মিজোরাম ও অরুণাচল রাজ্যে। এখন ত্রিপুরা বা মিজোরামে তারা সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পেলেও, অরুণাচলে তারা আজও বঞ্চিত রয়ে গেছে। অরুণাচলে বসবাসকারী চাকমাদের স্বীকৃতি না দিতে সেখানকার সব রাজনৈতিক দলও এককাট্টা এই প্রশ্নে সেখানকার কংগ্রেস ও বিজেপি পর্যন্ত একমত।
১৯৬৪ সালে আসামের গভর্নর (রাজ্যপাল) ছিলেন বিষ্ণু সহায়। চাকমারা যখন সীমান্ত পেরিয়ে দলে দলে মিজোরামে ঢুকছে, (মিজোরাম তখন আসামেরই অংশ ছিল), তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, এই চাকমাদের সঙ্গে স্থানীয় মিজোদের সংঘাত শুরু হবে অচিরেই। তাই তিনি কাপ্তাইয়ের কারণে উদ্বাস্তু হয়ে আসা এই অসহায়দের ‘নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি’ বা নেফার তিরাপ ডিভিশনে পাঠিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেন। কারণ, সেখানে তখন প্রচুর পরিমাণে ফাঁকা জমি পড়ে ছিল। সেই অনুযায়ী ১০ হাজারেরও বেশি চাকমাকে তখন ওই অঞ্চলের তিরাপ, লোহিত ও সুবনসিরি এলাকায় পুনর্বাসিত করা হয়। আর সেই দলে আরও হাজার দুয়েক হাজং জনগোষ্ঠীর লোকও ছিল।
সেই ‘নেফা’ই আজকের অরুণাচল প্রদেশ–পুনর্বাসিত চাকমা ও হাজংরা সেখানকার বিজন প্রান্তে গিয়ে ফসল ফলিয়েছে, বসত গড়েছে। তিরাপের মতো কোনও কোনও জেলার ভোল পর্যন্ত বদলে দিয়েছে তারা। আর এটাকে কেন্দ্র করেই তাদের ভূমিপুত্র অরুণাচলীদের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের।
শনিবার অরুণাচল প্রদেশের রাজধানী ইটানগরে ‘আপসু’ ও ‘আসু’র যৌথ কনক্লেভ ছিল চাকমাদের বিরুদ্ধে সেই সংঘবদ্ধ অভিযানে সবশেষ সংযোজন। সেখানে আপসু নেতারা বলেন, ‘অবৈধ’ চাকমা ও হাজংদের কারণে অরুণাচলের ভূমিপুত্ররা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং তাদের রাজ্যছাড়া করার জন্য সরকারকে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের অরুণাচল থেকে তাড়ানোর জন্য অচিরেই তীব্র আন্দোলন শুরু করারও হুঁশিয়ারি দেন তারা।
আসুর উপদেষ্টা ও অন্যতম শীর্ষ নেতা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্যও সেখানে ঘোষণা করেন, অবৈধ চাকমাদের অরুণাচলের মাটি থেকে নির্বাসিত করতে আপসু যে দাবি জানাচ্ছে, তাতে তারাও পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছেন।
‘চাকমা ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুহাস চাকমা অবশ্য পাল্টা দাবি করছেন, ‘চাকমারা কখনোই অরুণাচলে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নয়। ভারত সরকার ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে ১৪ হাজার চাকমা ও হাজংকে সেখানে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসিত করেছিল। প্রত্যেক পরিবারকে কিছু পরিমাণ কৃষিজমিও দেওয়া হয়েছিল।’
১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পর ওই সীমান্ত অঞ্চলে ভারতের নিরাপত্তা বাড়ানোর স্বার্থেই পরিকল্পনা মাফিক চাকমা-হাজংদের ওই পুনর্বাসন করা হয়েছিল বলেও তিনি জানান।
সুহাস চাকমা বলেছেন, ‘অরুণাচলের সঙ্গে চীন ও মিয়ানমারের সীমান্ত থাকলেও, বাংলাদেশের সঙ্গে কিন্তু কোনও সীমান্ত নেই। ফলে বাংলাদেশ থেকে চাকমা-হাজংরা সেখানে অবৈধভাবে ঢুকে পড়ে বসবাস করছে, এটা বলাটা “জেনোফোবিয়া” ছাড়া কিছুই নয়।’
এই জেনোফোবিয়ার কারণেই আজ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল জ্বলছে, অথচ মনিপুরের ঘটনা থেকেও কেউ যে শিক্ষা নিতে রাজি নয়, চাকমাদের অরুণাচল থেকে তাড়ানোর দাবিতে তা আরও একবার স্পষ্ট হলো বলে মনে করছেন সুহাস চাকমা।