রুশো মাহমুদ »
বাংলাদেশের প্রধান সামুদ্রিক বন্দর এবং একমাত্র স্বাভাবিক পোতাশ্রয় চট্টগ্রাম দেশের অর্থনীতির প্রাণভ্রোমরা। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের মোট আমদানি পণ্যের প্রায় ৮৫-৯০ শতাংশ এবং রফতানি পণ্যের ৮৫ শতাংশ পরিবাহিত হয়ে থাকে। সারা দেশেরতো বটেই প্রতিবেশী ভারতের উত্তর-পূর্ব ও পূর্বাঞ্চলীয় বিশাল অর্থনৈতিক পশ্চাৎভূমির সহজতম সামুদ্রিক করিডোর হিসেবে চট্টগ্রাম বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে বেগবান করতে চট্টগ্রামের সাথে কানেক্টিভিটির কোন বিকল্প নেই। অর্থাৎ চট্টগ্রামকে কানেক্ট করতে দরকার নিরবচ্ছিন্ন সড়ক ও রেল যোগাযোগ এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ জেলা ও দেশের বাইরে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়া পূর্বদিকের দেশ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং কোলকাতাসহ ভারতের উত্তর-পূর্ব ও পূর্বাঞ্চলীয় শহরগুলোর সাথে আকাশ পথে যোগাযোগ বাড়াতে হবে।
দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ‘লাইফলাইন’খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন থেকে আট লেনে উন্নীত করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে এসে মহাসড়কটি প্রশস্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অথচ ঢাকা-চট্টগ্রাম দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক রুট। ছয় বা আট লেনের সড়ক নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এ রুটে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা জরুরি। কারণ সারাবিশ্বেই এক্সপ্রেসওয়ের ধারণা এসেছে ব্যবসা-বাণিজ্যকে ফ্যাসিলিটেট করার জন্য।
পর্যটন, এনার্জি হাব থেকে শুরু করে নানা কারণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার গুরুত্বপূর্ণ। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে, হচ্ছে পতেঙ্গা বে টার্মিনাল এবং মিরসরাইতে দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল। দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবকাঠামোকে প্রস্তুত করে নেয়ার সময় দ্রুতই ফুরিয়ে যাচ্ছে।
মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের প্রস্তাবিত প্রকল্প এবং এই পথ সংলগ্ন শিল্পায়ন কার্যক্রম চট্টগ্রামকে এ অঞ্চলের বিশ্বমানের বাণিজ্যিক নগরীতে পরিণত করায় অবদান রাখবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে এই মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ প্রকল্পটি অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে গেছে। ফলে কর্ণফুলী টানেল এবছরের অক্টোবরে চালু হলেও টানেলের সড়কপথটি বহু বছর স্বল্প-ব্যবহৃত থেকে যাবে।
ভারতের পণ্য চালান চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে চারটি রুটে (পথ) বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে স্থলবন্দর হয়ে ভারতে নেওয়া যাবে। আবার একইভাবে ওই আটটি রুটে ভারত থেকে বাংলাদেশের স্থলবন্দর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য চালান আবার ভারতে নেওয়া যাবে। এই চারটি রুট হলো চট্টগ্রাম বন্দর-আখাউড়া-আগরতলা, চট্টগ্রাম বন্দর-তামাবিল ডাউকি, চট্টগ্রাম বন্দর-শেওলা-সুতারকান্দি এবং চট্টগ্রাম বন্দর-বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর।
নিকট ভবিষ্যতে যুক্ত হবে আরও দুটি স্থলবন্দর। একটি খাগড়াছড়ির রামগড় অন্যটি ফেনীর বিলোনিয়া। ট্রানজিট পণ্য পরিবহনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে সক্ষম করে তোলার দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রেলপথে ফেনী হয়ে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে পৌঁছানো সম্ভব। তাই বিলোনিয়া স্থলবন্দরের সাথে যুক্ত ফেনী- বিলোনিয়া রেল রুটটি সংস্কার ও পুনঃস্থাপনে ভারত সবধরনের সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভুটান ও চীন পরিবেষ্টিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহন সহজ করার লক্ষ্যে আখাউড়া-আগরতলার বিকল্প হিসেবে এ রেল রুট ব্যবহার করতে চায় ভারত।
ফেনী-বিলোনিয়া রেলপথটি পুনরায় চালু হলে যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধা বাড়ার পাশাপাশি ভারতের ত্রিপুরার সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়বে। এতে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে।
ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ফেনী রেলওয়ে স্টেশনের দূরত্ব ২৭ কিলোমিটার। রেলে বিলোনিয়া স্থলবন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আড়াই ঘণ্টায় পৌঁছানো সম্ভব হবে।
সড়কপথে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্ব ২৪২ কিলোমিটার। রেলপথের চেয়ে ৭৮ কিলোমিটার কম। রেল পরিবহন খরচ সাশ্রয়ী, নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব হওয়া সত্ত্বেও দূরত্ব ও বেশি সময় লাগার কারণে ট্রাক, বাস এবং কাভার্ডভ্যানের সাথে প্রতিযোগিতায় পারছে না। ঢাকা থেকে আখাউড়া হয়ে অস্বাভাবিক ঘুরপথের কারণে সময় ও অর্থ দুটোই নষ্ট হচ্ছে।
ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইন প্রকল্প রেলওয়ের একটি মাইলফলক পরিকল্পনা। ইলেকট্রিক ট্র্যাকশান কর্ডলাইন বাস্তবায়নে বেশকয়েকবার প্রাথমিক সমীক্ষাও করা হয়। কোনো অদৃশ্য কারণে এ প্রকল্পের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না।
ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রেন যোগাযোগ উন্নয়নে সবচেয়ে ভালো বিকল্প কর্ডলাইন। পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ইলেকট্রিক ট্র্যাকশনে রূপান্তর। এতে ব্যয় হবে হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণের পাঁচ ভাগের এক ভাগ। অল্প খরচে ও অল্প সময়ে কর্ডলাইন নির্মাণ সম্ভব। এ দুই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘণ্টায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়া যাবে।
কর্ডলাইন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সাধারণ যাত্রীরাও সাশ্রয়ী ভাড়ায় সহজে ভ্রমণ করতে পারবেন। রেলের আয় বাড়ার সঙ্গে সেবাও বাড়বে। রেলে আমূল পরিবর্তন আনতে কর্ডলাইন ও ইলেকট্রিক ট্র্যাকশনের কোনো বিকল্প নেই।
ঢাকা-চট্টগ্রামের রেলপথের দূরত্ব ৩২০ কিলোমিটার। কর্ডলাইন হলে ৯০ কিলোমিটার দূরত্ব কমে যাবে। ঢাকা-চট্টগ্রামের রেলপথের নতুন দূরত্ব দাঁড়াবে ২৩০ কিলোমিটার। যা সড়কপথের দূরত্ব থেকে কম।
ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার রেললাইনকে যুক্ত করতে পাহাড়তলী হয়ে দোহাজারী পর্যন্ত নতুন ব্রডগেজে কর্ড লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে রেলওয়ে।
পূর্বাঞ্চলে রেলের ব্রডগেজ লাইন স্থাপন হলে পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী ও খুলনার সঙ্গে চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হবে। পশ্চিমাঞ্চলে ব্রডগেজে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকলেও পূর্বাঞ্চলে এখন অবধি মিটার গেজ রেল চলছে।
এশীয় ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) থেকে অর্থায়নের প্রাথমিক নিশ্চয়তা পাওয়ার পর বাংলাদেশ রেলওয়ে আশা করছে, ২০২৭ সালের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের পুরো মিটারগেজ রেললাইনকে ব্রডগেজে রূপান্তরের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।
কক্সবাজার পর্যন্ত পুরো পূর্বাঞ্চলে ব্রডগেজ লাইন স্থাপনের মাধ্যমে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে সংযোগ স্থাপনের বাধাও দূর হবে। ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে সংযোগের মাধ্যমে চীন, পাকিস্তান, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ত হবে বাংলাদেশ।