খলিফাপট্টির দর্জিবাড়ি
নিজস্ব প্রতিবেদক <
খলিফাপট্টি। নগরীর দর্জিবাড়ি নামে খ্যাত। যে এলাকায় গেলে দিন কিংবা রাত বুঝা যাতো না। সারাদিন চলে দর্জিদের মেশিন। দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে কুমিল্লা, সিলেট পর্যন্ত সকল বয়সী মানুষের জামা কাপড়ের যোগান দেওয়া এ এলাকা এখন জনশূন্য।
রমজান উপলক্ষে বিনিয়োগ করা ব্যবসায়ীরা বলছেন এ বছর রমজানে যদি ব্যবসা করতে না পারে বেশিরভাগ ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারাবে। গতবছরের ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে এ নিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় একশোরও বেশি কারখানা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রেডি মেইড কাপড়ের জন্য খ্যাত খলিফাপট্টির পাইকারি দোকান সব জনশূন্য পড়ে আছে। ব্যবসায়ীরা বেকার সময় পার করছে। অন্যান্য বছরের এ সময়ে এ এলাকা ঘিরে থাকতো পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের ব্যস্ততা। কেউ কেউ দোকানে ছোট বাচ্চা বসিয়ে রেখে কোনভাবে দোকান খোলা রেখেছে। অন্যদিকে পোশাক তৈরি কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, পোশাক তৈরির ব্যস্ততা নেই শ্রমিকদের মাঝে। রমজান উপলক্ষে নতুন জামা কাপড়ের বদলে তৈরি করা হচ্ছে মাস্ক।
খলিফাপট্টি বণিক কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ২০১৯ সালে এ এলাকায় সাড়ে ৪’শ মালিকের প্রায় সাড়ে ৩’শ পোশাক তৈরি কারখানা ছিল। প্রতি কারখানায় ৩০ জনের বেশি শ্রমীক কর্মরত ছিল। এতে প্রয় ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক ছিল। কিন্তু গত বছরের লকডাউনে অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে দেওলিয়া হয়েছে। বর্তমানে এ এলাকায় ৪’শ ব্যবসায়ীর ২৮০টির অধিক কারখানা ও দোকান রয়েছে। শ্রমিক সংখ্যা কমে আনুমানিক সাত হাজারে নেমেছে।
জানা গেছে, ১৯৫০ দশকের দিকে আইয়ুব আলী নামে এক ব্যক্তি থান কাপড় থেকে জামা তৈরি করে তা ফেরি করে বিক্রয় করতো। তার সূত্র ধরে এ খলিফাপট্টির আবির্ভাব।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, খলিফাপট্টিতে রমজান মানে শ্রমজীবীদের দিতে হবে দ্বিগুণ শ্রম। মুনাফা অর্জনের সিজনও বলা চলে। কিন্তু এমন লকডাউন বিনিয়োগকারীদের জীবনে আসতে পারে দুর্ভোগ। কেউ কেউ ব্যবসার জন্য আত্মীয়স্বজন থেকে লাখ টাকা ধার করে বিনিয়োগ করেছে। যদি বার বার এভাবে লকডাউন দেয়, বন্ধ হয়ে যেতে পারে বেশিরভাগ কারখানা। নষ্ট হবে ৭ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান।
শুধু ব্যবসায়ীরা নয়, এর সাথে জড়িত রয়েছে আশপাশের এলাকার শত মানুষের শ্রম। যেমন ক্যাটারিং ব্যবসা, পাথরের ব্যবসা। আশপাশের এলাকার নারীরা স্বাবলম্বী হতে সাব কন্ট্রাকে কাপড়ে ফুল তোলা পাথর বসানোর কাজ করে। তাদের উপার্যনের পথও বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু এ দৃশ্য দ্রুত বিলীন হতে চলেছে বলে ধারণা করছেন তারা।
হোটেল ব্যবসায়ী মো. মঈনউদ্দিন মানিক বলেন, খলিফাপট্টিতে অনেক বছর ধরে ক্যাটারিং এর ব্যবসা করে সংসার চালায়। গত দু’বছর যাবৎ কর্মজীবী মানুষ কমেছে খাবারের ব্যবসায়ও ধস নেমেছে। কর্মচারী না থাকলে খাবার নেবে কে? আমার মত এমন আরও শত ব্যবসায়ীর এ অবস্থায় দিন কাটছে। তার উপর লকডাউন জীবনকে অতিষ্ট করে তুলেছে। গত বছরের বকেয়া টাকা না দিয়ে অনেকে চলে গেছে।
একজন পোশাক শ্রমিক মো. শহিদ বলেন, কারখানায় সেলাই কাজ করে চারজন সদস্যের সংসার চালায়। গত বছর করোনা লকডাউনে বাড়িতে গিয়ে মাটি কাটার কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ি। এ বছরে আবার আসলাম। এখন অবার লকডাউন। এমন হলে পরিবারকে না খেয়ে মরতে হবে। সরকার বড় বড় ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দেন। কিন্তু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বন্দি করে মারছেন।
সেলাই সামগ্রী বিক্রিয়কারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী নুরুল আমিন চৌধুরী বলেন, ১৯৭৮ সাল থেকে এ এলাকায় ব্যবসা করছি। গত দুবছরের মত শোচনীয় অবস্থা আগে কখনো হয়নি। এ অবস্থায় কিছু বলার মত ভাষা নেই।
গত বছরে বিনিয়োগ করতে না পারায় শত কোটি টাকা ক্ষতির ব্যাপারে জানালেন খলিফাপট্টি বণিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম। তিনি বলেন, গত এক বছরের ক্ষতি আগামী চার বছরে তুলে আনা সম্ভব হবে না। তবে এ বছরে ব্যবসা করার একটা সুযোগ ছিল। ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগও করেছে। যদি এভাবে বার বার লকডাউন দেওয়া হয় সব ব্যবসায়ী দেওলিয়া হয়ে যাবে। সরকারের পক্ষ থেকে কোন ধরনের সহায়তা করা হয় না।
তিনি আরও বলেন, সীমিত সময়ের জন্য হলেও মার্কেট খোলা রাখার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি। মার্কেট খোলা থাকলে বেচা বিক্রি হবে। আমাদের তৈরি মালও নষ্ট হবে না। মার্কেটের দোকানদারেরা বকেয়া পরিশোধ করার সুযোগ পাবে।