ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী »
দাদা নাতনি ভরা পূর্ণিমার চাঁদ দেখছে। দাদা দেখেন চাঁদের বুড়ি চরকা কাটছে, নাতনি দেখে রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে চলে যাচ্ছে। একজন আর একজনকে জিজ্ঞেস করে, “আমি যা দেখি তুমিও কি তা দেখ?” শৈশবে আমরা সন্ধ্যাকাশে ‘শুকতারা’ দেখতাম পরে জানলাম সেটি সপ্তর্ষিম-ল। এটি দেখার তারতম্যের জন্য ঘটে। একজনের দেখা অন্যজনের দেখার মিল নাও থাকতে পারে। কেননা দেখার ব্যাপারটাই আপেক্ষিক। দেখা কখনও এক হবে না। সাধারণের দেখা, বিজ্ঞানীর দেখা, দার্শনিকের বা শিল্পীর দেখারও পার্থক্য থাকে। দেখা বা দর্শন ব্যাপারটাই ধোঁয়াশাময়। আপাতদৃশ্যমান বস্তু ও দৃশ্যের কার্যকারণ-সাপেক্ষে অস্পষ্টতা, বহুধাস্তর ও বিভ্রান্তিকর রূপাবয়ব প্রকাশ পায়। আর এটাও স্বতঃসিদ্ধ যে, ব্যক্তির মতাদর্শ, রুচি, সংস্কৃতি, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের নিরিখেই দেখার প্রক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া পাল্টে যায়।
পক্ষান্তরে ‘দর্শন’ তো একটি ফলিত শাস্ত্র। এর অভিধা, বিস্তার, পরিসর ও আন্তঃসত্য অন্যরূপ তাৎপর্য বহন করে। মার্ক্স, হেগেল থেকে শুরু করে গ্রামসি হয়ে সাম্প্রতিক ফুকো, নোয়াম চমস্কি পর্যন্ত চিন্তন-সাম্রাজ্যে অনুঘটক (ঈধঃধষুংঃ)। চিন্তারাজ্যের পরিধি ও পরিসর ধ্রুব নয়। তা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনীয়, পুনর্নবায়িত। আর জগতের কোনো সত্যই তো কখনো ভূঁইফোঁড় কোনো তাৎক্ষণিক আবিষ্কার নয়। তা চলমান একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পরিণতি।
এতোসব ভারী প্রসঙ্গ এলো এ কারণে যে, মানুষের দৃশ্যমানতা ও দৃষ্টভঙ্গির যে বৈপরীত্য, মানুষে মানুষে তা পরিবর্তনীয় ও স্বতন্ত্র। কিন্তু কিছু দেখায় সত্যতা আছে। যেমন দিন-রাত্রি, চন্দ্র-সূর্য, ঝড়-বৃষ্টি বা জন্ম-মৃত্যু প্রভৃতি। ভাইরাস দেখা যায়না, মৃত্যু দেখা যায়। গত দেড় বছর ধরে বিশ্বে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন। এপর্যন্ত পৃথিবীতে ৪১ লক্ষ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। বাংলাদেশের এ সংখ্যা সতেরো হাজার অতিক্রম করেছে।
এখন সমস্ত পৃথিবীর দুঃসময়। পৃথিবীর গভীর-গভীরতর অসুখ। ২০১৯ সালে চীনের উহান থেকে উদ্ভূত করোনাভাইরাস ডিসিজ বা কোভিড-১৯ এখন মানবসভ্যতার ওপর বিপর্যয় ডেকে এনেছে। আমেরিকা, ব্রাজিল, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইটালি, জার্মান, চীন, ব্রিটেন ও ভারতসহ পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোও একটি সামান্য অণুজীবের আক্রমণ-দাপটে নাস্তানাবুদ। যারা পৃথিবীকে একটি সুইচ টিপে ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, সম্পদে ও গরিমায় যাদের অবস্থান আকাশচুম্বী, তারাও এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণুর মারণ থাবায় ল-ভ-।
আর আমরা তো অতি ছোট্ট একটি দেশ। টিকে আছি উদয়াস্ত লড়াই করে। ১৯৭১ সালে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত পোড়ামাটি থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সুসংগঠিত হতে শুরু করা দেশ। যদিওবা বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ধারাবাহিক শাসন ও নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের অনেক সূচকে এগিয়ে। বিশ্বের বহু দেশের মতো করোনা এসে হানা দিয়েছে আমাদের দেশেও। নেমে এলো মানবিক ও সামগ্রিক বিপর্যয়। সরকার, প্রশাসন, আওয়ামী লীগ অঙ্গ-সংগঠন ও কিছু ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান মহামারি মোকাবিলায় নানাভাবে এগিয়ে এসেছে। যেখানে মানুষের কল্যাণে, জীবনের প্রয়োজনে আবশ্যক ছিলো ঐকমত্যের, সেখানে বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল ও তাদের অনুসারী কতিপয় ব্যক্তির নানা সমালোচনা লক্ষ করা যায়। করোনা মোকাবিলায় সরকার নানা উদ্যোগ, কর্মসূচি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করে। জীবন-জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে জনসচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি, চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগে ফিল্ড হাসপাতাল, কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন জেলা উপজেলায় ল্যাব স্থাপন করে দ্রুত রোগী শনাক্তকরণ, টিকা প্রয়োগ ও টিকা আমদানি প্রভৃতি ব্যবস্থাপনায় সরকার তৎপর। অন্যদিকে পোশাক শিল্প ও অন্যান্য শিল্প উৎপাদন কার্যক্রমে উৎসাহিত করার প্রবণতাও লক্ষণীয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজ উদ্যোগে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় নিম্ন আয়, হতদরিদ্র জনগণ ও শিল্প বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য দুই প্রস্থে (প্রথমে ১২০০ কোটি এবং পরবর্তীতে গত ১৩ জুলাই ৩২০০ কোটি) প্রণোদনা ঘোষণা করেন।
টিকা ব্যবস্থাপনা, টিকা কূটনীতিতেও সরকারের সাফল্য ছিল। টিকা যখন বহু দেশের সোনার হরিণ, বাংলাদেশের তখন ৫৬ লক্ষ মানুষ টিকা পেয়েছেন। উল্লেখ্য, ভারতের সিরামে তৈরি এস্ট্রোজেনেকার টিকার ওপর নির্ভরশীল ছিল বাংলাদেশ। মাসিক কিস্তিতে অন্তত তিন কোটি টিকা পাওয়ার চুক্তি ছিল। করোনা নিয়ন্ত্রণে অন্তত একবছর পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দক্ষ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ বিশ্বের দশটি দেশের মধ্যে অনন্য স্থান লাভ করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতে বিপজ্জনকভাবে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির কারণে স্বদেশে টিকার স্বল্পতা দেখা দেয়। ভারতের টিকা প্রদানের অপারগতায় আমাদের টিকা প্রদানের পরিকল্পনার ছন্দ পতন ঘটায়।
করোনার আগ্রাসী ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধে নানা ব্যবস্থার পরও ভারতের সাথে তিন দিকের সীমান্ত যোগাযোগ, আমদানি বাণিজ্য ও ভারতগামী চিকিৎসা প্রার্থীদের যাতায়াতের কারণে বাংলাদেশে আবারো নতুন করে বাংলাদেশে সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় অনেকে মনে করেন। প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরে স্বাস্থ্যবিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না করে সাধারণ মানুষের বেপরোয়াভাবে ঘরে ফেরা, প্রবাসীরা যখন দেশে ফিরেন তখন হোম কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশন পালনে অনীহা, আন্তর্জাতিক পরিম-লে পোশাক শিল্পের বাজার ধরে রাখা, দুই ঈদে সাধারণ ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে শপিংমল খুলে দিলে জনগণের স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষার ফলে আমরা করোনার ভয়াল থাবায় আবারো আক্রান্ত হই।
তবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দক্ষ কূটনীতিতে আমরা স্বল্প সময়ের মধ্যে ফাইজার, সিনোফার্ম, মডার্নাসহ বিভিন্ন কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হই যার সুফল আমরা ইতোমধ্যে লাভ করতে শুরু করেছি। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী কয়েক মাসে অধিকাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে টিকা কার্যক্রম।
বর্তমানে ঈদুল আযহা উপলক্ষে সাধারণ ব্যবসায়ী, লক্ষ লক্ষ খামারিকে নির্বিঘেœ পশু বিক্রির জন্য পশুর হাট খুলে দেওয়া ও ধর্মীয় উৎসব পালনের কথা চিন্তা করে সরকার আগামী এক সপ্তাহের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করার ঘোষণা করলে একদল পরিকল্পিত সমালোচক সরব হয়ে উঠেছে। এক সময়ে ঈদের জন্য লকডাউন শিথিল করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল তারাও এখন সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে। যার যার অবস্থান থেকে সরকারের সমালোচনা করা যায় কিন্তু সরকার ৯০% মুসলমানের দেশে প্রধান ধর্মীয় উৎসবের সম্মানার্থে লকডাউন শিথিল করেছে যা অবশ্যই সময়োপযোগী। এছাড়াও সরকার শুধু জীবনের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, অনেক সময় জীবিকার কথাও চিন্তা করতে হয়।
সরকারের সমালোচনা করা সহজ কিন্তু স্বাস্থ্যবিধির সবচেয়ে সস্তা বিধান, মুখে মাস্ক পরার প্রতিও আমরা যতœবান হতে পারিনি। অনেকে সরকারকে টিকা কূটনীতিতে ব্যর্থ বলে বেড়াচ্ছেন। টিকার বিষয়টি শুধু কূটনীতির ওপর নির্ভর করে না, অনেক সময় ভৌগোলিক পরিবেশের ওপরও নির্ভর করে। যার কারণে সরকারের পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও ফাইজারের টিকা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। টিকা আনলে বলে, আগে প্রধানমন্ত্রী নিলে পরে অন্যরা নিবে, টিকা না পেলে বলে সরকার টিকা আনতে ব্যর্থ। কিছু বিষয়কে ইস্যু করে বিএনপি ঘোলাজলে মাছ শিকারের অপতৎপরতায় নেমেছিলো- পুরো জাতি নিশ্চয়ই এই স্বল্পসময়ে তা বিস্মৃত হয়নি।
এতোসব অপপ্রচার, গালমন্দ ও তৎপরতার পরও মানবতার নেত্রী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা যে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা ও প্রত্যয় নিয়ে সমস্ত পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন, তা পুরো বিশ্ব দৃষ্টান্ত ও অনুকরণীয় পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করেছে। তা আমাদের পুরো জাতির জন্যেই শ্লাঘার বিষয়।
একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মূল্যায়ন-পর্যালোচনায় কোভিড মোকাবিলায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারী দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল শীর্ষস্থানে। এই সংবাদ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
কোভিড-এর করাল থাবা বাংলাদেশে হানা দেওয়ার পর,প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত চরম ঘন-বসতিপূর্ণ এই দেশে, এই মহামারির বিস্তার ও এতজ্জনিত ফলাফল হিসেবে দুর্ভিক্ষ ও লক্ষ লোকের প্রাণহানির ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করেছিলো বিএনপি-জামায়াত চক্র। কিন্তু মা-মাটি-মানুষের নেত্রী শেখ হাসিনা প্রয়োজনীয় সংখ্যক ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন সহায়তার অর্থ। ১৩ জুলাই ঘোষণা তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা থেকে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া লোকেরা আড়াই হাজার টাকা পাবেন। শুধু তাই নয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শুরু থেকেই বিভিন্ন লাইভ অনুষ্ঠানে করোনা বিধিনিষেধ মানার নির্দেশনা প্রদান করেন। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার জনকল্যাণে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করে।কিন্তু একটি পক্ষ যেন উল্টোটাই দেখেন।
যখন গার্মেন্টস খুলে দেওয়া হলো, তখন সমালোচনার ঝড় বয়েছিল। বলা হয়েছিলো, গার্মেন্টসে করোনার চাষ করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের সকল আশংকা অমূলক ও প্রলাপ প্রমাণিত করে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব করোনা মোকাবিলায় যে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা ভাবীকালের জন্যে ইতিহাস হয়ে থাকলো। এই সিদ্ধান্ত যে কতো দূরদর্শী ও সুদূরপ্রসারী ছিলো, তা বর্তমান বাস্তবতায় জাজ্বল্যমান। গার্মেন্টস খুলে দেওয়ার মাধ্যমে অর্থনৈতিক গতি-প্রবাহ সঞ্চালনের যে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছিলো, তা সঠিক ও যথার্থ ইতিবাচক হিসেবে আজ প্রমাণিত। বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার একটি প্রধান ক্ষেত্র গার্মেন্টস সেক্টর। যখন করোনায় লকডাউনে এখন সবকিছুই স্তব্ধ, নিথর, তখনও প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ ছিলো অটুট, অক্ষুণœ। তাই দেশে কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি। একজন মানুষও না খেয়ে মরেনি। তা অবশ্যই শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব।
অতএব, বলার জন্য বলা বা বিরোধিতার জন্য বিরোধিতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে সর্বগ্রাসী বৈশ্বিক অতিমারি মোকাবিলায় সবাই ইতিবাচক হই, সবাই স্বাস্থ্য বিধিনিষেধ মেনে চলি।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও ইতিহাস লেখক
সাবেক ডিন কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়