সুভাষ দে »
করোনা মহামারি আমাদের জীবনযাপন, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল কিছুকে বিপর্যস্ত করে চলেছে। কবে এর শেষ হবে কেউ বলতে পারছে না। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান অন্যান্য মহামারির প্রকৃতি অনুধাবন করে বলেছেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে করোনা মহামারির অবসান হতে পারে। আবার একদল গবেষক বলছেন করোনা দীর্ঘদিন স্থায়ী হতে পারে।
করোনায় বিশ্ব ১ম পর্যায় অতিক্রম করেছে শোকাবহ মৃত্যু আর নানা ঘাতপ্রতিঘাতে বিপর্যস্ত হওয়ার মধ্যে। এখন প্রতিরোধের পর্যায় শুরু হয়েছে প্রতিষেধক, টিকা আবিষ্কারের প্রস্তুতি আর স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার কিছুটা উন্নতির মাধ্যমে, জনসচেতনতায় এবং জীবন ও জীবিকা দুটিকেই গুরুত্ব দিয়ে।
করোনার অভিঘাতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, একেবারে প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত চরম বিপর্যয়ের মুখে। এর ফল সুদূরপ্রসারী, মানবসম্পদ গড়ে তোলার কাজটি নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়বে, কেবল তাই নয় শিক্ষার্থীদের মনোজগতেও নেতিবাচক নানা প্রভাব পড়বে। আমাদের দেশে লেখাপড়া ক্লাস নির্ভর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে ১৬ মার্চ থেকে (করোনার প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছে ৮ মার্চ)। তাছাড়া অক্টোবরের ৩ তারিখ পর্যন্ত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ঘোষণা রয়েছে। দীর্ঘ কয়েক মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সিলেবাস অসম্পূর্ণ, বছরের প্রথম প্রান্তিক থেকে ছেদ পড়েছে পাঠদানে। কবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে, পাবলিক ও বার্ষিক পরীক্ষা কিভাবে নেয়া হবে তারও সঠিক দিক নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। তবে প্রাথমিক ও এবতেদায়ী পরীক্ষা অন্যান্য বছরের মতো না নিয়ে স্কুল ভিত্তিক মূল্যায়নের প্রস্তাব দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ বছরের জেএসসি, জেডিসি পরীক্ষাও বাতিল করা হয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দূরশিক্ষণ পদ্ধতি চালু করা হলেও শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই যুক্ত হতে পারেনি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষার্থী ইন্টারনেট সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকায় তাও সুফল বয়ে আনছে না। তার সাথে আরো যুক্ত আছে বিদ্যুৎ খরচ ও ইন্টারনেট চার্জ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে অনলাইনে কøাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে উপরোক্ত সমস্যাগুলো বিবেচনা না করেই। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনের প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পারে না। (সূত্র : বণিক বার্তা, ২৪ আগস্ট)
করোনাজনিত দীর্ঘ ছুটিতে শিক্ষার্থীদের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সতীর্থদের সাথে মেলামেশা, খেলাধুলা ও পড়ালেখা নিয়ে আলাপ-আলোচনা তাদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখতো যা এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। ঘরে তারা অলস সময় পার করছে। পড়ালেখায়ও মন বসাতে পারছে না। অভিভাবকরাও তাই এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিশোর তরুণরা এসময়ে ভার্চুয়াল জগতে খুব বেশি নিমগ্ন হয়ে পড়েছে। করোনার অভিঘাতে অভিভাবকদের কর্মহীনতা ও দারিদ্র্য বেড়েছে। ফলে তাদের সন্তানদের লেখাপড়াও এক প্রকার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শহরে নি¤œ ও মধ্যবিত্ত যারা খুব কষ্টে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন, তাদের পক্ষে এখন তা বোঝা হয়ে পড়েছে। অনেকের কাজ নেই। যারা ছোটো-খাটো ব্যবসা ও হকারি করতেন, তা এখন অনেকটাই বন্ধ। কারখানার চাকরিজীবীদের অনেকেই ছাঁটাই হয়েছেন। বেতন-মজুরিও কমে গেছে। বেসরকারি অফিস-আদালতেও ছাঁটাই, বেতন কমার খবর আসছে। শহরের বাসা ছেড়ে দিয়ে অনেক পরিবার চলে গেছেন গ্রামে। তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার এখন কি হবে? বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন, স্কুল ও কলেজের অনেক শিক্ষক অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে দিন যাপন করছেন। গ্রামাঞ্চলেও অভিভাবকদের অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হয়েছে। আর সে প্রভাব পড়বে সন্তানদের লেখাপড়ার ওপরও।
গত ১ দশকে শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা অসংগতি সত্ত্বেও উন্নতি হয়েছে। প্রাথমিকে ভর্তি হওয়ার হার প্রায় শতভাগ। মাধ্যমিকে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। উচ্চ মাধ্যমিকেও তাদের সংখ্যানুপাত ছেলেদের কাছাকাছিতে। ঝরে পড়াও কমেছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে বর্তমান পরিস্থিতি হতাশা নিয়ে এসেছে। গত বছরের এইচএসসি পরীক্ষা এখনো অনুষ্ঠিত হয়নি। অনুরূপভাবে বিশ্ববিদ্যালয়েও সেশনজট তৈরি হবে। তদুপরি তরুণ-তরুণীদের বর্তমান পরিস্থিতি হতাশার চিত্রের আভাস দিচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের সরকারি-বেসরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত পরিবারের। অনেকে আবার গ্রামের কৃষকের-সন্তান। করোনার অভিঘাতে অভিভাবকদের জীবনে নেমে এসেছে দুর্দশা। এ অবস্থায় সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়াটাও তাই দুঃসাধ্যের ব্যাপার।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বাংলাদেশ প্রাইমারি এডুকেশন: অ্যানুয়াল সেক্টর পারফর্ম্যান্স রিপোর্ট ২০১৯
(এ এস পি আর) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুদের ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ পঞ্চম শ্রেণি শেষ করার আগেই ঝরে পড়ে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) প্রকাশিতব্য শিক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার ৩৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ। (বণিক বার্তা, সোমবার ২৪ শে আগস্ট) করোনার এ পরিস্থিতিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার আরো বাড়বে।
করোনায় দেশে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা। (ইউনেস্কো) সম্প্রতি এক পলিসি ব্রিফে তারা এ তথ্য জানিয়েছে। (পূর্বসূত্র)
এদিকে নীতিনির্ধারক কোনো কোনো পর্যায়ে অটো প্রমোশনের কথা বলা হচ্ছে; একে তো সিলেবাস একেবারেই অসম্পূর্ণ, অন্যদিকে অটোপ্রমোশন, এর ফলে শিক্ষার গুণগত মান ধরে রাখা কষ্টকর হবে। করোনা কাল যদি আরো দীর্ঘায়িত হয় তবে শিক্ষাক্ষেত্রে বড় শূন্যতা দেখা দেবে।
মানসিক পরিস্থিতিজনিত এক জরিপে উঠে এসেছে শিক্ষাজীবন, ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান নিয়ে এক প্রকার সংশয় কাজ করছে তরুণ শিক্ষার্থীদের মনে।
শিক্ষা, জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্য করোনার সাথে এইসব বিষয় এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু এখনো উদ্বেগজনক। তদুপরি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার যে বেহাল দশা তাতে মানুষের মনে আস্থাহীনতাও তেরি হয়েছে। মানুষের মধ্যে এ রোগের ভয়াবহতা নিয়ে সচেতনতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থায় এই বিপর্যয়কর অবস্থা কবে কাটবে কেউ তা বলতে পারছে না। সরকার থেকে টেলিভিশন ও অনলাইনে পাঠদানে বিশেষ সুবিধা হয়নি। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট ও ডিভাইস সুবিধা দিতে হবে শিক্ষার্থীদের।
তবে বর্তমান এ পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের দায়িত্ব বেশি। সন্তানদের লেখাপড়ায় ফেরানো, তাদের কাছ থেকে নিয়মিত পড়া আদায়, তাদের পড়ার টেবিলে সময় দেওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলোতে নজর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তাদের নিয়ে বাইরে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগও তৈরি করতে হবে। নির্মল বিনোদনে তাদের একান্ত সঙ্গী হতে হবে।
শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে সরকারকে সচেষ্ট হতে হবে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের ‘শিক্ষা খরচ’ প্রদান, অভিভাবকদের দারিদ্র্য নিরসনে পদক্ষেপ গ্রহণ ও তাদের জীবিকার সংস্থান করে দেওয়া জরুরি। এজন্য আমাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সাজাতে হবে। শিক্ষার ক্ষেত্রটি অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রণোদনার বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জীবন ও জীবিকার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।
সামনে যে সময়ে ক্লাস শুরু হবে সে সময় শিক্ষকদের ঘাটতি হবে। কেননা অনেকেই গ্রামে চলে গেছেন, অনেকেই কৃষিকাজে নিয়োজিত হয়ে পড়েছেন জীবিকার তাগিদে, অনেকে পেশা পরিবর্তন করেছেন বাধ্য হয়ে।
সামনে এইচএসসি পরীক্ষা কিভাবে হবে? গতো বছরের এইচএসসি পরীক্ষা এখনো অনুষ্ঠিত হয়নি। এই পাবলিক পরীক্ষাগুলো উচ্চ শিক্ষা ও বিশেষায়িত শিক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কয়েকটি স্কুল ও কলেজ নিয়ে (কাছাকাছি) পরীক্ষা নেয়ার বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে, তবে এসব নির্ভর করে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির ওপর। বর্তমান অবস্থায় শিক্ষাকাল দীর্ঘ বা সেশনজট হলেও সেটা মেনে নিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রেডিও, টেলিভিশন ও অনলাইনে ক্লাস করার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সাথে সকল শিক্ষার্থী যাতে এর সুবিধা নিতে পারে সেটিও সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। মনোজগত সমৃদ্ধ করতে, তাদের হতাশা কাটাতে লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রোগ্রাম থাকা চাই। গণমাধ্যমগুলো এই ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষা ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জস্বরূপ। এটিকে ধীর-স্থির গতিতে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এই সমস্যা কেবল শিক্ষার নয়, বরঞ্চ তা আমাদের অর্থনীতি, জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য নিরসন, সামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির সাথে সম্পর্কিত।
লেখক : সাংবাদিক