নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার »
ঘূর্ণিঝড় ‘হামুনের’ আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়েছে কক্সবাজার। নেই বিদ্যুৎ, নেই মোবাইল নেটওয়ার্কও। একই সঙ্গে সড়ক- উপসড়কে গাছ উপড়ে যানবাহন চলাচলও বন্ধ রয়েছে। তবে জেলা প্রশাসন বলছে, ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণে জরুরিভিত্তিতে বিশেষ এলাকায় বিদ্যুৎসংযোগ চালুর চেষ্টা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে মোবাইল অপারেট সমূহের সঙ্গে আলাপ চলছে দ্রুত সময়ে নেটওয়ার্ক সমস্যার সমাধান করতে। বিদ্যুৎ আর মোবাইল নেটওয়ার্ক সচল থাকলে দ্রুত সময়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, কক্সবাজারে ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে তিনজনের প্রাণহানিসহ অন্তত শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন।
কক্সবাজার শহরে ‘১৫ হাজার’ ঘরবাড়ির ক্ষতি
ঘূর্ণিঝড় ‘হামুনের’ তা-বে কক্সবাজার পৌরসভায় ‘অন্তত ১৫ হাজার’ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; যার মধ্যে পুরোপুরি বিধ্বস্ত ‘সাড়ে পাঁচ হাজার’। বুধবার বিকাল ৪টায় কক্সবাজারের পৌর মেয়র মো. মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে পৌরসভার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ১ নম্বর ওয়ার্ড। পৌর কাউন্সিলররা তালিকা তৈরি করেছেন; বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকশ পরিবারকে সন্ধ্যার মধ্যে টিন ও নগদ অর্থ সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
পৌর মেয়র আরও বলেন, এখন পর্যন্ত জেলা-উপজেলার বিভিন্ন সড়ক চলাচল উপযোগী করে তোলা হয়েছে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় আঘাতের ২৪ ঘণ্টা পরেও কক্সবাজারে এখনও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে বলে জানান তিনি।
কক্সবাজার সদর, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলায় ভেঙে গেছে কমপক্ষে আড়াই হাজার ঘর। ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণে জরুরিভিত্তিতে বিশেষ বিশেষ এলাকায় বিদ্যুৎসংযোগ চালু এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক সচলকে গুরুত্ব দিচ্ছে প্রশাসন।
গতকাল বুধবার দুপুর ১২টার দিকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানান, ঘূর্ণিঝড় হামুনের সবচেয়ে বড় আঘাত হয়েছে প্রকৃতির ওপর। ঠিক কী পরিমাণ গাছ ভেঙে গেছে তার সঠিক পরিমাণ বলা যাচ্ছে না। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অন্তত ১৫টি স্থানে গাছ ভেঙে গেছে বলে জানতে পেরেছি। যেসব গাছ ভেঙে রাস্তায় পড়ে আছে তা দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সকাল থেকে মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক। তবে অভ্যন্তরীণ সড়কের পরিস্থিতি এখনও পুরোদমে স্বাভাবিক করা সম্ভব হয়নি। সড়ক বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস এসব এলাকায় কাজ করছে।
তিনি আরও জানান, এ মূহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক। প্রাথমিক তথ্য থেকে জানা গেছে, বিদ্যুৎ সব এলাকায় চালু করতে দুই দিনের বেশি সময় লাগবে। মহেশখালী উপজেলায় ১৫টি ট্রান্সফরমার, শতাধিক খুঁটি ভেঙে গেছে বলে জানা গেছে।
মহেশখালী কুতুবদিয়া আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক জানান, মহেশখালীতে একজনের মৃত্যু ও সাপের কামড়ে তিনজন আহত হয়েছেন। ক্ষতির পরিমাণ এখন বলা মুশকিল। দুই উপজেলায় ব্যাপক গাছ ও ঘর ভেঙে গেছে।
কক্সবাজার বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল কাদের গণি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে উপড়ে গেছে অসংখ্য বৈদ্যুতিক খুঁটি। ছিড়ে গেছে অংসখ্য তার। এখন বৈদ্যুতিক সংযোগ দিলে প্রাণহানি ঘটতে পারে, তাই আপাতত বিদ্যুৎসংযোগ বন্ধ রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন তিনটি সাব-স্টেশন চালু করা হয়েছে। প্রধান সড়কগুলোতে কাজ শেষ হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রধান সড়কে বিদ্যুৎসংযোগ চালু করা সম্ভব হবে। আর পুরো কক্সবাজারে বিদ্যুৎ চালু হতে অন্তত দুই দিন সময় লাগবে।’
কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ইনচার্জ অতীশ চাকমা বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে হাজার হাজার গাছ উপড়ে গেছে। যার কারণে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে যান চলাচল ব্যাহত হয়েছিল। রাত ৩টা পর্যন্ত কাজ করে এসব মহাসড়ক ও সড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করা হয়েছে। এখন শহরের সড়ক-উপসড়কগুলো থেকে উপড়ে পড়া গাছ কেটে, তা সরিয়ে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করা হচ্ছে। কিছুটা সময় লাগবে, কারণ অনেক বেশি গাছ উপড়ে সড়কে পড়েছে। চেষ্টা করছি, দ্রুত সরিয়ে সড়কে যানবাহন চলাচলের উপযোগী করার।’
কক্সবাজারে তিন জনের মৃত্যু
মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) রাতে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিভীষণ কান্তি দাশ জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত ঘুর্ণিঝড়ের তা-বে তিন জন মারা গেছে। তাদের মধ্যে একজন পৌরসভা এলাকায়, একজন মহেশখালী ও একজন চকরিয়ায় মারা গেছেন। ঘূর্ণিঝড় হামুনের প্রভাবে ঝড়ো হাওয়ায় দেয়াল ও গাছ চাপা পড়ে তাদের মৃত্যু হয়। কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ঝড়ে মঙ্গলবার রাতে পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাহাড়তলী এলাকায় আধা পাকা ঘরের দেয়াল চাপা পড়ে আবদুল খালেক (৪০) নামের এক ব্যক্তি মারা গেছেন।
মহেশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মাহফুজুল হক বলেন, বড় মহেশখালী ইউনিয়নে রাতে ঘরের সামনের গাছ চাপা পড়ে হারাধন দে (৪৫) নামে একজন মারা গেছেন। তিনি মাথায় আঘাত পান, হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়। জানা গেছে, চকরিয়াতেও গাছ চাপায় একজনের মৃত্যু হয়েছে।
সুপেয় পানি ও ব্যবহারের পানির জন্য দীর্ঘ লাইন
খাবার পানি ও ব্যবহারের পানির জন্য কক্সবাজার শহরের গোলদিঘীর পাড়স্থ অনুকূল ঠাকুরের সৎসঙ্গ আশ্রম ও এনজিও সংস্থা মুক্তি অফিসের কাছে ভুক্তভোগীদের পানির জন্য লাইন ধরতে দেখা গেছে। পৌর শহরের অধিকাংশ স্থানে টিউবওয়েল (চাপাকল) নেই। সবাই বিদ্যুৎচালিত টিউবওয়েল (বোম মোটর) এর উপর নির্ভরশীল। হামুনের কারণে বিদ্যুৎ বিছিন্নের কারণে পানি সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। শহরের সুউচ্চ অধিকাংশ বিল্ডিংয়ে নিজস্ব কোন জেনারেটর নেই। যার ফলে পানি বিদ্যুৎ চালিত (বোম মোটর) গুলো অকেজো হয়ে পড়ে। এ কারণেই দেখা দেয় পানি সংকট।