নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার »
করোনার প্রকোপ কিছুটা কমায় দীর্ঘ ৪ মাস ১৯ দিন পর কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত খুলে দেয়া হলে পর্যটকের দল নেমেছে। দীর্ঘদিন সমুদ্রস্নান ও বালিয়াড়িতে খেলার আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকা পর্যটকরা এবার মাত্রাতিরিক্ত আনন্দ, হৈ-হুল্লোড়ে পুষিয়ে নিচ্ছেন। । ওয়াটর বাইক, স্পিডবোট ও টায়ারসহ ইত্যাদি নিয়ে মেতেছেন অনেকেই। তবে এই বেড়ানোর আনন্দ বিষাদে রূপ নিচ্ছে। বাড়ছে অপমৃত্যু ও নানা দুর্ঘটনা।
গত এক সপ্তাহে সৈকতে নেমে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। হোটেলে ‘অতিরিক্ত মদপানে’ দুই পর্যটকের মৃত্যু এবং শখের প্যারাসেইলিং করতে গিয়ে নারী পর্যটক মারত্মক আহত হয়েছেন। এসব অপমৃত্যু ও দুঘর্টনায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন সচেতন মহল। পর্যটন সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব ও নজরদারিকে আরো গুরুত্ব সহকারে দেখছেন তারা। তবে পর্যটকদের অসাবধানতা ও লাইফগার্ডের দেয়া নির্দেশনা যথা- জোয়ার-ভাটার সময়সূচি, হুঁশিয়ারি বাঁশি, বিভিন্ন সংকেত ও লাল পতাকার সংকেত অমান্য করাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের নাজিরারটেক পয়েন্ট থেকে শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) বেলা পৌনে ১২টার দিকে নাম-পরিচয় না জানা ৩৫ বছর বয়সী এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে লাইফ গার্ড কর্মীরা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (পর্যটন সেল) সৈয়দ মুরাদ ইসলাম। মারা যাওয়া যুবক স্থানীয় নাকি পর্যটক সে বিষয়ে কিছু নিশ্চিত করতে পারেননি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
বিচকর্মীদের সুপারভাইজার মাহবুব আলম জানান, শনিবার সকাল সাড়ে ১১টার পর সৈকতের নাজিরারটেক পয়েন্ট এলাকা থেকে এক যুবককে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। লাশটি মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছে।
সুত্র জানায়, গত ৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে তৌনিক মকবুল (২৩) এর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তৌনিক ঢাকার শ্যামলীর আদাবর এলাকার বাসিন্দা নুরুল ইসলামের ছেলে।
১৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার সময় দরিয়া নগর এলাকায় নিয়ম ভেঙে সন্ধ্যায় প্যারাসেইলিং করতে গিয়ে ঢাকার খিলখেত এলাকার তারিকুল ইসলামের স্ত্রী তিন্নি আক্তার (২৬) মারাত্মক আহত হন। নিয়ম হচ্ছে প্যারাসেইলিংয়ের শেষ সময় বিকেল ৩টা পর্যন্ত। এই নিয়ম করে জেলা প্রশাসন সৈকতের পয়েন্ট নির্ধারণ করে বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু সেই নিয়ম ভেঙে ৫ মিনিটে ২ হাজার টাকা করে লোভে সন্ধ্যা হয়ে গেলেও প্যারাসেইলিং চালু রাখা হয়। সন্ধ্যার অন্ধকারে ঠিকমতো ঠাওর করতে না পেরে ভুল ল্যান্ডিংয়ে পায়ে মারাত্মক চোট পান তিন্নি আক্তার। কক্সবাজার বেড়ানো মাঝপথে বন্ধ করে চিকিৎসার জন্য ঢাকা ফিরে যান তিনি।
১৭ সেপ্টেম্বর দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার ব্যবধানে সমুদ্র থেকে দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। দুপুর ১টায় সীগাল পয়েন্টে ভেসে আসে ১৭ বছর বয়সী মোহাম্মদ ইমন নামের কিশোরের লাশ। এর দুই ঘণ্টা পর একই পয়েন্টে বিকেল ৩টায় উদ্ধার হয় আরও এক অজ্ঞাত যুবকের মরদেহ। ওইদিন সকালে কক্সবাজার শহরের কলাতলীর একটি আবাসিক হোটেলে অতিরিক্ত মদ পানের কারণে অসুস্থ হয়ে দুই বন্ধুর মৃত্যু হয়েছে। দুজনই চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের কর্মী বলে জানা গেছে। শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সকালে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মহিউদ্দিন আহমেদ। হোটেল রেজিস্ট্রারে থাকা ঠিকানা মতে- তিন বন্ধুর বাড়ি চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানাধীন এলাকায়। জানা গেছে, কক্সবাজারে একটি আবাসিক হোটেলে অতিরিক্ত মদ পানের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিন বন্ধু। পরে তাদের কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকালে রাফসানুল হক (৩০) নামের একজনের মৃত্যু হয়। এছাড়া সাইমুন প্রিয়াম ও রায়হানের অবস্থার অবনতি হলে তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই দিন রাত সোয়া ২টায় সাইমুন প্রিয়ামের মৃত্যু হয়।
গত এক সপ্তাহে পানিতে ডুবে ৪ জনের মৃত্যু, অতিরিক্ত মদপানে ২জনের মৃত্যু আর প্যারাসেইলিং থেকে ছিটকে ১ জন আহতসহ ছোট-বড় নানা দুর্ঘটনা ঘটছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে।
এ ব্যাপারে সী সেইফ প্রোগ্রাম ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘সমুদ্রসৈকতের পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগে সমুদ্রের অবস্থা যেরকম ছিল এখন ঠিক সেরকম নেই। প্রাকৃতিক নিয়মে সাগরের তলদেশ দিন দিন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। সাগরে এখন বড় বড় গুপ্তখালের সৃষ্টি হচ্ছে। এটি একটি পরিবেশগত কারণ। এছাড়া আগে এক জায়গার মধ্যে অনেক মানুষ দেখা যেত, কিন্তু এখন সমুদ্রসৈকত সোজা হয়ে যাওয়ায় মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা সমুদ্রসৈকত সোজা কিংবা প্রসার পেয়ে অনেকদূর পর্যন্ত চলে যায়। লাইফগার্ডেও সংকেত মানে না। লাল পতাকা দিলেও তারা সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পানিতে নেমে গোসল করে। সৈকতে আমাদের লাইফগার্ড কর্মী আছে মাত্র ২৭ জন। সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে আসা এতোগুলো মানুষকে অল্প সংখ্যক লাইফগার্ড কর্মী দিয়ে নজরদারি রাখাটা খুব জটিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া আমাদের সংগঠনের অর্থনৈতিক সংকটে আমরা আরো বেশি লাইফগার্ড নিয়োগ দিতে পারছি না। এই ডিসেম্বরেই প্রজেক্ট শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মূলত লাইফগার্ড কম থাকায় অনাকাঙ্খিত ঘটনা গুলো ঘটছে।
তিনি আরও বলেন, সমুদ্রসৈকত খুলে দেয়ার পর থেকে সী সেইফ লাইফগার্ড পানিতে ভেসে যাওয়া ৩১৫ জনকে রক্ষা করেছে। আমরা পর্যটকের সেবা নিশ্চিতে সবসময় আন্তরিক ও প্রস্তুত রয়েছি।’
এদিকে, শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকালে সমুদ্র সচেতনায় ১০ দিনের ক্যাম্পেইনের উদ্বোধন করেছেন জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ। ‘সতর্কতাই নিরাপত্তার পূর্বশর্ত’ এই প্রতিপাদ্যে সমুদ্রের পানিতে নামার আগে করণীয় ও সতর্কতার ব্যাপারে সচেতনতামূলক বক্তব্য রাখেন তিনি।
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘সমুদ্রের পানিতে নামার আগে কিছু সতর্কবার্তা এই ১০ দিন আমরা প্রচার করতে চাই। পর্যটক যারা আসবেন তাদের তো জানা নেই যে এখানে লাইফগার্ড আছে। এখানে সিকিউরিটির ব্যবস্থা আছে। কোসো চিহ্ন দিয়ে কি অর্থ প্রকাশ পায়, লাল পতাকার অর্থ কীÑ সেগুলোর বর্ণনা আছে। আত্মীয়-স্বজন, পরিবার পরিজন নিয়ে যারা কক্সবাজার সৈকতে বেড়াতে আসেন তারা অনেক সময় সিগনালগুলো খেয়াল করতে পারে না। তাদের অবগতির জন্য এই আয়োজন করা হয়েছে। তাদের সহায়তার জন্য এখানকার বিচকর্মীরা সার্বক্ষণিক সজাগ রয়েছেন।’
ওইদিন জেলা প্রশাসক জানান, আগামী দশ দিন পর্যন্ত কলাতলী, সুগন্ধা এবং লাবণী বিশেষ করে এই তিনটা পয়েন্টে এরকম প্রচার অভিযান চালানো হবে। এখন থেকে পর্যটকরা সমুদ্রস্নান কিংবা পানিতে নামার আগে প্রশাসনের দেওয়া নির্দেশনা ও সময়সূচি মেনে সমুদ্র সৈকতে নামবেন। এসময় তিনি পর্যটকদের সহযোগিতার আহ্বান জানান। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে নামার আগে পর্যটকদের ১০টি নির্দেশনা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।