আদালতে জবাব দিতে বলা হয়েছে : বাদির আইনজীবী
এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে : ওয়াসার এমডি
ভূঁইয়া নজরুল »
শেষ হয়েও হলো না শেষ। চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুায়ারেজ প্রকল্পের ভূমি জটিলতা সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়ে ২০১৭ সালে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তা স্থিরতায় এসেছিল। কিন্তু শেষ হওয়া সেই ঘটনা পুনরায় উজ্জীবিত হলো চট্টগ্রাম তৃতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালতে।
৪ এপ্রিল শুনানি শেষে গতকাল ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার স্যুায়ারেজ প্রকল্পের উপর অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত। আদালতে হাজির হয়ে বাদির অভিযোগের বিষয়ে জবাব না দেয়া পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকার কথা বলা হয়েছে আদেশে।
নগরীর মধ্যম হালিশহর আনন্দবাজার এলাকায় চলছে ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্রকল্পের কাজ। সাগর থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে মাটি ভরাটের কাজ করছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মাঝপথে প্রকল্পের কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত।
নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদি ছৈয়দ মুহাম্মদ এনামুল হক মুনিরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম ওয়াসা ১৯৬৩ সালে ১৬৩ দশমিক ৮৫ একর জায়গা অধিগ্রহণ করেছিল। কিন্তু ১৯৭০ সালের ৫ আগস্ট ১৩৪ দশমিক ১৫ একর জায়গা ডি রিকুজিশন (অর্থাৎ রিকুজিশন বাতিল করা হয়) করা হয়। সে হিসেবে ওয়াসা বর্তমানে যেখানে স্যুয়ারেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেখানে স্থানীয়দের জায়গা রয়েছে। ওয়াসাকে এ জায়গা নতুন করে অধিগ্রহণ করতে হবে অন্যথায় আমাদের জায়গা আমাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। সেজন্য আমরা মামলা করেছিলাম। আদালত মামলার শুনানি শেষে ওয়াসার কাজের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।’
এ বিষয়ে বাদি পক্ষের আইনজীবী ব্যরিস্টার আফরোজা আকতার বলেন, ‘তৃতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালতের বিচারক নুসরাত জাহান আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। একইসাথে ওয়াসা যতদিন বাদির আবেদনের বিপরীতে আদালতে উপস্থিত হয়ে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন না করবে ততোদিন এ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে।’
কিন্তু গত ৪ এপ্রিল (সোমবার) শুনানিতে ওয়াসার পক্ষে কেউ উপস্থিত ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওয়াসার পক্ষ থেকে আদালতের সমন রিসিভ করা হলেও তাদের পক্ষে কেউ আদালতে উপস্থিত ছিল না।’
অপরদিকে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘প্রথমত আদালত থেকে আমরা কোনো সমন পাইনি। যদি কোনো সমন পেতাম তাহলে অবশ্যই আমাদের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকতো। দ্বিতীয়ত একটি চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে এভাবে নিষেধাজ্ঞা দেয়া যায় না। আর এ বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে এবং সেখান থেকে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। জেলা প্রশাসক তা সুরাহা করে ওয়াসার পক্ষে মতামত দিয়ে তা সুপ্রিমকোর্টকে অবহিতও করেছে। এখন হয়তো নিম্ন আদালতে বিষয়টি সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। আমাদের প্রতিনিধি আদালতে উপস্থিত হয়ে বিষয়টি উপস্থাপন করবে।’
জটিলতা কোথায়?
ওয়াসা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে জানা যায়, ১৯৬৩ সালে ওয়াসা প্রতিষ্ঠার সময় হালিশহর আনন্দবাজার এলাকার ১৬৩ একর জায়গা স্যুায়ারেজ প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। তৎকালীন সময়ে জেলা প্রশাসন সেই জায়গা অধিগ্রহণ করে এর দখল ওয়াসাকে বুঝিয়ে দেন ১৯৬৭ সালের ২৫ মে। সেই থেকে এই জায়গা চট্টগ্রাম ওয়াসার।
কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন ভিন্ন কথা, তাদের দাবি এই জায়গা অধিগ্রহণ কার্যক্রম অসম্পূর্ণ ছিল। অধিগ্রহণ করার কথা থাকলেও পরবর্তীতে জেলা প্রশাসন ১৯৭০ সালের ৫ আগস্ট অধিগ্রহণ বাতিল করে। সেই হিসেবে এ জায়গার মালিক স্থানীয়রা। এ বিষয়ে আদালতে মামলাও হয়েছিল।
২০০১ সালে হাইকোর্টে দায়ের করা পিটিশান মামলায় উল্লেখ করা হয়, অধিগ্রহণকৃত ১৬৩ একর জায়গায় ওয়াসার প্রকল্পটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় ভূমির মূল মালিকগণের ওয়ারিশ ও দর-ওয়ারিশগণ উক্ত ভূমি ফেরত চায়। ১৯৬৩ সালে ভূমি অধিগ্রহণের পর ২০০১ সালে কেন মামলা করা হলো এবং ক্ষতিপূরণের কথা কেন বলা হচ্ছে- এমন প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয়দের পক্ষে বলা হয়েছে তখনকার সময়ের মানুষ জায়গা জমি নিয়ে অনেক কম বুঝতো তাই কেউ তা নিয়ে মামলা করেনি।
হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টের রায়ে জেলা প্রশাসনকে সুরাহা করতে বলায় চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক সামসুল আরেফিন ২০১৭ সালের ৯ মে তারিখের আদেশে বলা হয়, ১৯৯৭ সালের অধিগ্রহণ সংক্রান্ত নির্দেশনাবলীর ৭৭ ও ৭৮ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট নির্দেশনা অনুযায়ী অধিগ্রহণকৃত অব্যবহৃত ভূমি পূর্বতন মালিকের অনুকূলে অবমুক্তির সুযোগ নেই। তাই ২০০১ সালের ৯ জুলাইয়ে আবেদনকারীর আবেদন না মঞ্জুর করা হলো।
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, ভূমি অধিগ্রহণ আইনে কারো কোনো আপত্তি থাকলে তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আপিল করতে হয়। এই সময়ের পরে আর তা নিজের বলে মন্তব্য করা যায় না। সেই হিসেবে ভূমির মূল্য পাওয়া যায়নি তা বিবেচনায় আসার সম্ভাবনা নেই। তারপরও আবেদনকারীর সব তথ্য বিবেচনা করে হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্ট জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর একনেক সভায় স্যুয়ারেজ প্রকল্পের ৩৮০০ কোটি টাকা গ্র্যান্ট (অনুদান) হিসেবে চট্টগ্রাম ওয়াসাকে দিয়েছে। একনেকে অনুমোদনের প্রায় তিন বছর পর গত বছর কোরিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্প নির্মাণের কার্যাদেশ পায়। কার্যাদেশ পাওয়ার পর গত মাস থেকে প্রকল্প এলাকায় ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে মাটি ভরাট কার্যক্রম চলছে। ২০২৪ সাল নাগাদ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রাম মহানগরীর একাংশ এলাকার ভবনের সেপটিক ট্যাংক থাকবে না। অর্থাৎ ভবন থেকে সরাসরি পয়োঃবর্জ্য চলে যাবে স্যুয়ারেজ প্ল্যান্টে। এতে কর্ণফুলী ও হালদা নদী দূষণ থেকে রক্ষা পাবে।