বে টার্মিনাল
ভূঁইয়া নজরুল »
বে টার্মিনালকে বলা হয় চট্টগ্রামের আগামীর বন্দর। বিগত নয় বছর ধরে বে টার্মিনাল নিয়ে সরব আলোচনা চলমান থাকলেও বাস্তবে ধীরে চলছে। কিন্তু ধীরে চললেও বে টার্মিনালের অন্যতম উপাদান ব্রেক ওয়াটার রক্ষায় সচেতন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। তাই সম্প্রতি অনুমোদন ছাড়া বে টার্মিনাল এলাকা থেকে ওয়াসার মাটি উত্তোলন কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে অনুমোদন পেলেও সেখানে শর্ত জুড়ে দেয়া হয় অবশ্যই ড্রেজারে জিপিএস (অবস্থান নিশ্চিতকরণ যন্ত্র) বসাতে হবে। আর সেই শর্ত মেনেই এগুচ্ছে ওয়াসা।
ড্রেজারে জিপিএস বসানোর কথা স্বীকার করে চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুায়ারেজ প্রকল্পের মাটি ভরাটের কাজে নিয়োজিত পাওয়ার বাংলা সংস্থার জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের শর্ত অনুযায়ী আমরা আমাদের দুটি ড্রেজারে জিপিএস লাগিয়েছি। আরো দুটি ড্রেজার যুক্ত করবো ড্রেজিংয়ের কাজে, সেগুলোতেও জিপিএস লাগানো হবে।’
জিপিএস কেন লাগাতে হচ্ছে জানাতে চাইলে তিনি বলেন, মূলত বন্দর কর্তৃপক্ষ যে স্থান থেকে মাটি উত্তোলনের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে সেই স্থান থেকে মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে কিনা তা মনিটরিং করতে এই জিপিএস লাগানোর আয়োজন।
এ বিষয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহানের সঙ্গে। তিনি বলেন, বে টার্মিনালে সাগরের অংশে একটি প্রাকৃতিক চর রয়েছে। সেই চরটি ব্রেক ওয়াটার (পানির ঢেউ থেকে বাঁচতে এক ধরনের বাঁধ) হিসেবে কাজ করবে। চর থেকে যাতে মাটি নিতে না পারে তা আমরা নিয়ন্ত্রণ করছি। একইসাথে চ্যানেল থেকে মাটি উত্তোলনের অনুমোদন দিচ্ছি। এতে চ্যানেলের গভীরতাও বেড়ে যাবে।’
কিন্তুু জিপিএস লাগানো হচ্ছে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ সেই চর থেকে যাতে তারা মাটি উত্তোলন না করে এবং যে জায়গা থেকে মাটি উত্তোলনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে সেই জায়গার বাইরে গেলে তা শনাক্ত করতে সহজ হবে। বন্দর ভবন থেকে তা মনিটরিং করা হবে এবং হাইড্রোগ্রাফি বিভাগের একটি জরিপ জাহাজও সেখানে থাকবে। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে ড্রেজিং করতে পারবে।’
ওয়াসা কেন মাটি উত্তোলন করছে জানতে চাইলে ওয়াসা স্যুয়ারেজ প্রকল্পের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘স্যুয়ারেজ প্রকল্পের জমিতে মাটি ফিলিংয়ের কাজ রয়েছে। আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বলেছি আমাদের প্ল্যান্ট সমুদ্র সমতল থেকে ছয় মিটার উঁচু করতে হবে। আর তা উঁচু করতে যে পরিমাণ মাটি প্রয়োজন তা বঙ্গোপসাগর থেকে আহরণ করা হবে।’
ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, হালিশহর আনন্দবাজার এলাকায় ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্রকল্পটি সমুদ্র সমতল থেকে তিন মিটার উঁচু রয়েছে। আরো তিন মিটার উঁচু করতে প্রায় ৭৫ লাখ ৩ হাজার ৩৭৫ ঘনফুট মাটি প্রয়োজন। এজন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে বে টার্মিনাল চ্যানেলের ৫০০ বাই ৪০০ মিটার আয়তনের একটি ব্লক নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এ স্থান থেকে এক দশমিক শূন্য সাত মিটার গভীরতা পর্যন্ত মাটি উত্তোলন করতে পারবে ওয়াসার ড্রেজার।
প্রাকৃতিক ব্রেক ওয়াটার তথা বিদ্যমান চর
ইপিজেডের পেছন থেকে দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনি ঘাট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বে টার্মিনাল। এরমধ্যে ইপিজেডের পেছন দিকে সাগরের প্রায় এক কিলোমিটার ভেতরে উত্তর দক্ষিণে লম্বালম্বি আকারে দুটি চর রয়েছে। এই চর দুটি জোয়ারের সময় প্রায় ডুবে যায়। কিন্তু চর ও উপকূলের মধ্যবর্তী অংশে পানির গভীরতা ৭ থেকে ৮ মিটার। এ গভীরতা থাকা এলাকাটি চওরায় প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা এবং দৈর্ঘ্যে সাড়ে ৬ কিলোমিটার। সাগরের ভেতরের এই দুই চরকে শাসন করে ১৪ মিটার চওড়া ও ৫ থেকে ৬ মিটার উচ্চতার দেয়াল নির্মাণ করা হতে পারে। আর এই দেয়ালকে বলা হয় ব্রেক ওয়াটার। উপকূলের অংশে নির্মাণ হবে জেটি। জেটি ও ব্রেক ওয়াটারের মধ্যবর্তী জায়গায় এসে জাহাজগুলো প্রবেশ করবে।
জানা যায়, দুটি চরের মধ্যবর্তী জায়গায় প্রায় এক কিলোমিটারের মতো অংশ ফাঁকা রয়েছে, অর্থাৎ এই অংশে পানির গভীরতা ৭ থেকে ৮ মিটার রয়েছে। মধ্যবর্তী এই ফাঁকা অংশের চওড়া কমিয়ে ৭০০ থেকে ৮০০ মিটারে আনা হতে পারে। এই ৭০০ থেকে ৮০০ মিটার চ্যানেল দিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জাহাজগুলো বে টার্মিনালের ভেতরে প্রবেশ করবে। পণ্য উঠানামার পর আবার জাহাজগুলো যেদিক দিয়ে প্রবেশ করবে সেদিক দিয়ে বের হয়ে যাবে। একসাথে দুই বা তিনটি জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে।
ব্রেক ওয়াটার কেন প্রয়োজন?
হাইড্রোগ্রাফারদের মতে সাগর থেকে আসা বড় বড় ঢেউয়ের আঘাতে যাতে জেটি নষ্ট না হয় সেজন্য দূর থেকেই ঢেউটিকে বাধা দেয়ার জন্য ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করতে হয়। বিশ্বের অনেক বন্দরে কৃত্রিমভাবে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করতে হয়। কিন্তু বে টার্মিনালের সাগরের অংশে এ ধরনের একটি চর থাকাতে প্রাকৃতিকভাবেই ব্রেক ওয়াটার সুবিধা পাওয়া গেছে। এখন শুধু এই প্রাকৃতিক চরকে শাসন করে ব্রেক ওয়াটারটিকে আরো একটি শক্তিশালী করা হচ্ছে। এরফলে উপকূলের দিকে থাকা জেটি নিরাপদ থাকে।
উল্লেখ্য, হালিশহরের ইপিজেড থেকে দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনি ঘাট পর্যন্ত সাগরের ভেতরের প্রায় ২৩০০ একর জায়গায় বে টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এতে তিনটি টার্মিনাল হবে। একটি টার্মিনাল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নির্মাণ করবে এবং বাকি দুটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ ভিত্তিতে বিদেশি সংস্থা নির্মাণ করবে।