মূল্যবৃদ্ধি ও সংকট তৈরি না করার আহ্বান চিটাগাং চেম্বারের #
অসাধু ব্যবসায়ীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে হাজারিগলিতে মানববন্ধন ও সিএমপির হটলাইন চালু #
রুমন ভট্টাচার্য :
করোনা ভাইরাস সংক্রমণে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েছে চলেছে। সেই সাথে বাড়ছে মৃত্যু। এমন পরিস্থিতিতে, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ফার্মেসিতে ভিড় বাড়ছে প্রতিনিয়ত। কয়েকগুণ বেড়েছে ওষুধের চাহিদা। চলছে দাম নিয়ে চরম নৈরাজ্য। বেড়েছে সিন্ডিকেটের দাপট। পাইকারি থেকে খুচরা সব ফার্মেসিতেই তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম সংকটের। সংকটের অজুহাতে দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছে প্রয়োজনীয় প্রায় সব ওষুধের দাম। আবার কোনো কোনো ওষুধের দাম নেওয়া হচ্ছে ৫-১০ গুণ বেশি এমন অভিযোগ ক্রেতাদের। এছাড়া অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিসহ দাম বেশি নেওয়ার চিত্র তুলে ধরছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের ওষুধ প্রশাসন আছে। এই প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া ওষুধের দাম বাড়ানোর নিয়ম নেই। কিন্তু সে নিয়ম অনিয়মে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে ওষুধের দামের কোনো লাগাম নেই। যে যেভাবে পারছে সেভাবে নিচ্ছে। সিন্ডিকেটের দাপটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
চট্টগ্রামে প্রায় ৩৭০০ করোনা রোগী রয়েছে। সেই সাথে শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি করোনার উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরো কয়েক হাজার মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাজারী লেইন, কে সি দে রোড, মেডিক্যাল এলাকার প্রায় ১৮০০টি ওষুধের দোকান রয়েছে। এর মধ্যে হাজারী লেইনে ১০০০, কে সি দে রোডে ৫০০ ও মেডিক্যাল এলাকায় ৩০০।
ওষুধ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ছোট সাইজ ৩০ টাকার স্যাভলন বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা, বড় সাইজ ২২০ টাকার স্যাভলন বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৭০০ টাকায়। ২০ টাকা ডক্সিক্যাপ ট্যাবলেট ৫০ টাকা, ১৫০ টাকার আইভেরা-৬ ৭০০ টাকা, ৫০ টাকার স্কাবো-৮০০ টাকা, ২৫ জিঙ্ক ২০ এমজি ৫০ টাকা, ২০ টাকা সিভিট ৪০ টাকা, ৮ টাকার নাপা ৩০ টাকা, ৪৮০ টাকার মোনাস ১০ এমজি ১০৫০ টাকা ও ৬০ টাকার সার্জিক্যাল বক্স ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
হাজারী গলিতে ওষুধ কিনতে যাওয়া কাঞ্চন চক্রবর্তী বলেন, ‘ইভেরা-৬ এর মূল্য প্যাকেটে লেখা ছিল ১৫০ টাকা। চাওয়া হচ্ছে ৭০০ টাকা। রশিদ দিতে বললে ওষুধ বিক্রি করবে না বলে জানায়। আরো দু’একটি দোকান ঘুরলাম। সবার কথা প্রায় একই। এরপর বাধ্য হয়ে কিনলাম।’
মইনুল ইসলাম নামে একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের মেইন গেটের কয়েকটি ফার্মেসিতে ১০০০মিলি স্যাভলনের দাম ৭০০ টাকা ও এক বক্স সার্জিক্যাল মাস্কের ২২০ টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে ছবি ও ভিডিওসহ তুলে ধরেন। তিনি লেখেন, ‘আসল কথা হচ্ছে মেডিক্যালপাড়ার ফার্মেসিগুলোতে রীতিমতো ডাকাতি চলছে। জীবন বাঁচানোর সরঞ্জামগুলো নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে গলা কেটে, বাধ্য করে টাকা নেওয়া হচ্ছে।’
এদিকে, করোনা রোগীর জন্য অক্সিজেনের চাহিদা বাড়ায় সেটিরও দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি। বর্তমানে ১২ হাজার টাকার ১.৩৬ ঘনমিটার অক্সিজেন সিলিন্ডার দাম ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ক্যাব এর চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন অভিযোগ করে বলেন ‘বাজারে ওষুধ প্রশাসনের কোনোর তদারকি ও নজরদারি নেই। ওষুধ প্রশাসনের গাফিলতির কারণে দাম প্রকট আকার ধারণ করেছে। তারা জানে এসবের সাথে কারা কারা জড়িত। চাইলে তারা তাদের বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নিতে পারত। কিন্তু এখানে ওষুধ প্রশাসনের কোনো ভূমিকা শুরু থেকে ছিল না এখনও নেই। ওষুধ প্রশাসনই তাদের ডাকাতি করার সুযোগ করে দিচ্ছে।’
অভিযোগ অস্বীকার করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর চট্টগ্রাম এর সহকারী পরিচালক হোসাইন মোহাম্মদ ইমরান বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। মানুষ ওষুধের দাম বেশি নিচ্ছে বলে কিন্তু কেউ প্রমাণ ও সাক্ষী দিতে বললে আসে না। ফলে সাক্ষী ছাড়া আমরা কাউকে ধরতে পারি না। ওষুধ কেনার সময় অবশ্যই রশিদ নিতে হবে এবং দাম বেশি নিলে সেটি আমাদের জানাতে হবে।’ তবে দেশে কোনো ওষুধের সংকট নেই বলে জানান তিনি।
ওষুধের দাম ঊর্ধ্বগামী জানিয়ে বাংলাদেশ কেমিস্ট ড্রাগিস্ট সমিতির চট্টগ্রাম জেলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়ন আশীষ ভট্টাচার্য বলেন, ‘ওষুধ সরাসরি না এসে এখন বিভিন্ন হাত ঘুরে আসছে। এছাড়া হাজারী লেইনে ভাসমান বিক্রেতাদের উৎপাত বেশি। এগুলো বন্ধে প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছি। বর্তমানে ব্যবসা থেকে সেবাটা জরুরি। সে নির্দেশনা আমরা সবাইকে দিয়েছি। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে অন্যদের সুনাম ক্ষুণœ হচ্ছে। প্রশাসন নজরদারি বাড়ালে অসাধুরা বের হয়ে আসবে। সমিতি থেকে কাউকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।’
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী-পরিচালক মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, ‘বাড়তি দামে ওষুধ বিক্রির অনেক অভিযোগ এসেছে এবং প্রতিনিয়ত পাচ্ছি। স্যাভলন, স্ক্যাভো-৬, ইভেরা-১২ ইত্যাদি নিয়ে অভিযোগ বেশি আসছে।’ শীঘ্রই ব্যবস্থার নেওয়ার কথা জানান তিনি।
চিটাগাং চেম্বার অব কমার্সের আহ্বান
বর্তমান করোনা মহামারিকালে সাধারণ ওষুধসহ বিভিন্ন ধরনের সুরক্ষা সামগ্রীর কৃত্রিম সংকট তৈরি ও অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধি করে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তির শিকার না করতে ওষুধ ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম ।
গণমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় তিনি বলেন, ব্যবসা একটি মহান পেশা। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এই সংকটকালীন সময়েও মানবিকতা ভুলে গিয়ে মানুষের প্রয়োজনকে জিম্মি করে খুব সহজলভ্য ওষুধেরও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ৩/৪ গুণ বেশি দামে বিক্রি করছে অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায়। মানুষের বিপদকে পুঁজি করে মুনাফা আদায় মানবতা বিবর্জিত ও গর্হিত অপরাধ।
তিনি সাধারণ জনগণকে অপ্রয়োজনে আঙ্ককিত না হয়ে কোন প্রকার ডাক্তারের পরামর্শ বা চিকিৎসাপত্র ছাড়া ওষুধ ক্রয় না করার আহ্বান জানান।
হাজারী গলিতে মানববন্ধন
নিত্য প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী সংকট সৃষ্টিকারী অসাধু ব্যবসায়ী এবং ভ্রাম্যমাণ হকার উচ্ছেদের দাবিতে রোববার (৭) মে সকালে শিব মন্দির প্রাঙ্গণে মানবন্ধন করেছে হাজারী লেইন এলাকারী। এসময় কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী উপস্থিত ছিলেন।
অভিযোগ জানাতে সিএমপির হটলাইন
কোনো ফার্মেসিতে নির্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত দামে ওষুধ বিক্রি করা হয় বা অসাধু উপায়ে মজুদ করা হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়েছেন সিএমপি কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান।
নগরের বাসিন্দারা সিএমপির হটলাইন (০১৮ ৮০ ৮০ ৮০ ৮০) নম্বরে ফোন করে অভিযোগও জানাতে পারবেন। অভিযোগ পেলে ওই ফার্মেসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে সিএমপির পক্ষ থেকে। এছাড়া বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিও।
এ মুহূর্তের সংবাদ