সুপ্রভাত ডেস্ক »
আফগানিস্তানের শীর্ষ তালেবান নেতা একটা ডিক্রি জারি করে বিভিন্ন গ্রুপের নেতা ও কমান্ডারদের বহু বিবাহ না করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটা করে আমাদের শত্রুদের আমরাই সুযোগ করে দিচ্ছি সমালোচনা করার।’ বিবিসি’র সংবাদদাতা খুদাই নুর নাসার এ খবর দিয়েছেন।
ধর্ম অনুসারে মুসলমান পুরুষরা চারটা বিয়ে করতে পারেন। আর পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং কিছু মুসলিম অধ্যুষিত দেশে বহুবিবাহ এখনও বৈধ। কিন্তু তালেবান সূত্রগুলো বিবিসিকে বলেছে, এই বহুবিবাহ করতে গিয়ে কমান্ডারদের অধিক অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। এর কারণ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের অনেক পশতুন আদিবাসী পরিবারে বিয়ে করতে হলে কনে পক্ষকে চড়া পণ দিতে হয়। খবর বাংলাট্রিউনের।
এই ডিক্রি এমন এক মুহূর্তে জারি করা হলো যে সময়টা তালেবান এবং দেশটির জন্য রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর। দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও মার্কিন সমর্থিত আফগান সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছে তালেবান। সূত্র বলছে, দলটির শীর্ষ নেতারা তাদের সদস্যদের দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা বহুবিবাহকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য অর্থ জোগাড় করার উদ্যোগ নিয়েছে।
বেশিরভাগ জ্যেষ্ঠ তালেবান নেতাদের একাধিক স্ত্রী আছে। তবে যারা আগে থেকেই বহুবিবাহে আছে তাদের ক্ষেত্রে এই নতুন ডিক্রি প্রযোজ্য হবে না।
ডিক্রিতে কী বলা হয়েছে?
আফগান তালেবান নেতা মোল্লা হাইবাতুল্লাহর নামে ইস্যু করা এই ডিক্রিতে বলা হয়েছে, দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ বিয়েকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। তবে বিয়ের উৎসবে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করা হচ্ছে, তাতে তালেবানদের যারা প্রতিপক্ষ তাদের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে সমালোচনা করার।
ডিক্রিতে বলা হয়েছে, ‘যদি সব নেতৃত্ব এবং কমান্ডার বহুবিবাহ এড়িয়ে চলেন, তাহলে তাদের অবৈধ দুর্নীতিতে জড়াতে হবে না।’ তবে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। বহুবিবাহ যেসব পুরুষরাই করতে পারবে যাদের কোনও সন্তান নেই বা যাদের আগের বিয়ে থেকে ছেলে সন্তান নেই, অথবা যারা একজন বিধবাকে বিয়ে করছে কিংবা যারা একের অধিক স্ত্রীর ভরণপোষণ করতে সক্ষম।
ডিক্রিতে বলা হয়েছে, এই পরিস্থিতিতে যদি কেউ বহুবিবাহ করতে চান, তাহলে বিয়ের আয়োজনের আগেই তাকে তার সরাসরি ঊর্ধ্বতন নেতার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। তালেবানের সোর্স বিবিসিকে জানিয়েছে, এই চিঠির বিষয় আফগানিস্তান, পাকিস্তান তালেবানের সর্বস্তরে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বহু বিবাহ কতটা বিস্তার লাভ করেছে?
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পশতুন সমাজে বহু বিবাহের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে মেয়েদের আসলে তেমন কিছুই বলার থাকে না যে তারা কাকে, কখন বিয়ে করবে। গ্রামীণ পুরুষতান্ত্রিক পশতুন সমাজে বিয়ের পর বাচ্চা না থাকা বিশেষ করে ছেলে সন্তান না থাকাকে আরেকটি বিয়ে করার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়। আরেকটা কারণ হলো সংসারে ঝগড়া-বিবাদ, যার জন্য কেবল স্ত্রীকেই দায়ী করা হয়।
একজন বিধবাকে তার মারা যাওয়া স্বামীর ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। এতে বিধবা এবং পরিবারের সম্মান দুটোই রক্ষা পায়। যদিও যে ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে তিনি আগে থেকেই বিবাহিত হতেই পারেন। আর যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল তাদের জন্য বহু বিবাহ একটা মর্যাদার ব্যাপার।
এসব বিয়েতে ‘ওয়ালওয়ার’ বা কনের মূল্য নামে এক প্রথা রয়েছে, যার ফলে কনের পরিবার মেয়েকে স্বামীর হাতে তুলে দেওয়ার বিনিময়ে অর্থ পায়।
এদিকে অর্থনৈতিক চাপ এবং সামাজিক আচরণ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গত কয়েক দশক ধরে আফগানিস্তানে বহু বিবাহকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায় আফগান অ্যাকটিভিস্ট রিটা আনওয়ারি মনে করেন, আধুনিক বিশ্বে এই ধারণাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে ‘পুরুষের অভিলাষ’ নাম দিয়ে।
ইসলাম পুরুষদের একাধিক বিয়ে করার অনুমোদন দিয়েছে। তবে কিছু নির্দিষ্ট শর্তে। যেমন যদি স্ত্রী অসুস্থ থাকে এবং বাচ্চাদের যতœ নিতে না পারে। সেখানেও নির্দিষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ আদেশ রয়েছে। অ্যাকটিভিস্ট রিটা আনওয়ারি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজকের দিনে পুরুষরা তার শক্তির এবং ক্ষমতার জোরে তাদের অভিলাষ পূর্ণ করার জন্য সব নিয়ম-কানুন ভুলে বসে আছে।’ তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তির একাধিক বিয়ে করা সম্পূর্ণ ভুল, যদি সে সব স্ত্রীকে সমানভাবে আর্থিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে যতœ নিতে না পারে।’
তালেবান নেতাদের বহু বিবাহ:
বেশিরভাগ জ্যেষ্ঠ তালেবান নেতার একাধিক বিয়ে রয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মৃত মোল্লা মোহাম্মদ ওমর এবং তার উত্তরসূরি মোল্লা আখতার মানসুর তাদের দুই জনেরই তিন জন করে স্ত্রী ছিলেন। তালেবানের বর্তমান প্রধান মোল্লা হাইবাতুল্লাহর দুই জন স্ত্রী। যখন বিবিসির পক্ষ থেকে তালেবান সূত্রকে জিজ্ঞেস করা হয়, কোন তালেবান নেতার একাধিক স্ত্রী আছে? সূত্র থেকে পাল্টা প্রশ্ন এসেছে, ‘কার নেই?’
এখন কেন বহু বিবাহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে?
অনেক বছর ধরে আফগানিস্তানের সরকারি কর্মকর্তারা বলে আসছেন, যখন তালেবান নেতারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করে আসছেন, সেখানে সৈনিকরা একেবারে দিন আনে দিন খায় অবস্থায় দিন কাটায়। গত বছর দাভোস ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি একটা প্যানেল আলোচনায় বলেছিলেন, ‘ভালো খবর হলো তালেবান যোদ্ধারা যুদ্ধ করতে করতে এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং এখন তারা চতুর্থ ও পঞ্চম স্ত্রীর সঙ্গে দারুণ সময় কাটাচ্ছেন।’ এছাড়া তালেবান নেতাদের জন্য কনের মূল্যও আর্থিক বিবেচনায় উদ্বেগের হয়ে দাঁড়িয়েছে। খবর পাওয়া যাচ্ছে, একটা বিয়ের জন্য তারা ২৬ হাজার পাউন্ড থেকে এক লাখ পাউন্ড পর্যন্ত খরচ করছে। এই অর্থ তারা সংগঠনের ফান্ড থেকে নিচ্ছে অথবা বিতর্কিত উপায়ে জোগাড় করছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা।