নিজস্ব প্রতিনিধি, সাতকানিয়া »
সাতকানিয়ায় ইউনিয়ন (ইউপি) পরিষদ নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই উত্তপ্ত হচ্ছে নির্বাচনী মাঠ। প্রতিদিনই কোন না কোন ইউনিয়নে ঘটছে সংঘর্ষ ও হামলা-মামলাসহ গুলি বর্ষণের ঘটনা।
জানা গেছে, মঙ্গলবার সকালে ধর্মপুর ইউনিয়নে সংঘর্ষে আনোয়ার আলী নিহতের ঘটনায় থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ ধর্মপুর থেকে ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন ধর্মপুরের আবদুল মোতালেবের ছেলে আবু নঈম (৪২), একই এলাকার মৃত ছৈয়দ আহমদের ছেলে আবুল কালাম (৫৬), মৃত নুর আহমদ এর ছেলে রফিকুল ইসলাম (৪৫) ও মৃত ওয়াহেদ বক্স এর ছেলে আবদুস শুক্কুর (৫২)। মূলত আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর অনুসারীদের সাথে এ সংঘর্ষ হয়।
বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর অভিযোগ, উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটাচ্ছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় কয়েক ধাপে ইউপি নির্বাচন শেষ হলেও কোথাও সাতকানিয়ার মত উত্তাপ দেখা যায়নি। বর্তমান সংঘাতময় পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে জনমনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন ও সংশ্লিষ্টরা সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বললেও সাধারণ ভোটাররা তাদের এ আশ্বাসে বিশ্বাস করছে না।
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, সাতকানিয়ায় সপ্তম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১৬টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ৩৮ জন, সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ১৪২ জন ও সাধারণ সদস্য পদে ৫৮০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ইতোমধ্যে কেঁওচিয়া ইউনিয়নে উত্তর সাতকানিয়া যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ওচমান আলী, পুরানগড়ে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ফ ম মাহাবুবুল হক সিকদার, মাদার্শায় উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আবু নঈম মোহাম্মদ সেলিম ও সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক মো. সেলিম প্রতিদ্বন্দ্বী কোন প্রার্থী না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বেসরকারিভাবে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
জানা গেছে, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে দলীয় প্রতীক নৌকা পাওয়ার জন্য মনোনয়ন-বাণিজ্য নিয়ে আলোচনায় আসে সাতকানিয়া। জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলী ও দক্ষিণ জেলা যুবলীগ নেতা কামাল উদ্দিন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হোসেন কবিরের মাধ্যমে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমদকে ১৫ লাখ টাকা প্রদানের অভিযোগ করেন। পরবর্তীতে সংবাদ সম্মেলনে করে এ অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন মোছলেম উদ্দিন মোছলেম উদ্দিন। জামায়াতের দুর্গ হিসেবে পরিচিত সাতকানিয়ায় এই বিভক্তির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন জামায়াত, বিএনপি ও এলডিপি নেতাকর্মী।
অন্যদিকে অনেক আওয়ামী লীগ প্রার্থী জামায়াত-বিএনপির দলীয় পদবীধারীদের নির্বাচনী প্রধান উপদেষ্টা ও ধারক-বাহক বানিয়ে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন বলে তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেছেন। এদিকে নির্বাচন সংক্রান্ত এ পর্যন্ত থানায় ১১টি মামলা ও অভিযোগ দায়ের হয়েছে বলে ওসি আবদুল জলিল জানিয়েছেন। এসব অভিযোগ ও মামলা অধিকাংশই বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে করা হয়েছে।
এদিকে চরতি ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জামায়াত ইসলামের সাবেক কর্ম পরিষদ সদস্য প্রয়াত মাওলানা মুমিনুল হক চৌধুরীর ছেলে রুহুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্ব কৃষকের উপর গুলি বর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র পূর্বে থেকে দু’টি বিবদমান গ্রুপ ছিল। প্রথমে এলাকায় ঢুকতে না পারলে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক প্রচারণায় নামেন চরতি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও বিদ্রোহী প্রার্থী মঈনুদ্দিন চৌধুরী। উভয়পক্ষ নির্বাচনী কার্যালয় পোড়ানোকে কেন্দ্র করে একে অপরকে দোষারোপ করছেন।
বিদ্রোহী প্রার্থী মঈনুদ্দিন ক্ষমতাসীর দলের প্রার্থী রহুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ভোট কেড়ে নেয়ার আশংকা করে বলেন, চরতি এখন সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হয়েছে।
তবে নৌকার প্রার্থী রহুল্লাহ চৌধুরীর দাবি, মঈনুদ্দিন তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছেন। একই ঘটনা ঘটছে কাঞ্চনা ইউনিয়নে সরকার দলীয় প্রার্থী রমজান আলী ওতার সাঙ্গপাঙ্গরা শুরুতেই স্বতন্ত্র প্রার্থী মঈনুদ্দিন হাসান এর উপর হামলা চালান। বিভিন্ন সময় প্রচারণায় বাধা প্রদানেরও অভিযোগ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মঈনুদ্দিন হাসান। তিনি ইতোমধ্যে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। তার এ রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে যে কোন ধরনের হয়রানি থেকে বিরত থাকতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনসহ সকলকে নির্দেশ দিয়ে এক আদেশ জারী করেন কোর্ট। অপরদিকে বাজালিয়ায়ও বিরাজ করছে সহিংস অবস্থা। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী তাপস কান্তি দত্ত তার নির্বাচনী কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ করে থানায় মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় বিদ্রোহী প্রার্থী শহিদুল্লাহ চৌধুরী প্রধান আসামি। আদালত থেকে শহিদুল্লাহসহ অনেকেই জামিনে বের হলেও বেশ কয়েকজন এখনও জেলে রয়েছেন।
সোনাকানিয়ায় বিদ্রোহী প্রার্থী মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন চৌধুরী তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় নৌকার প্রার্থী জসিম উদ্দিনের সমর্থকরা হামলা চালিয়ে গাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ করেছেন। তবে জসিম তা অস্বীকার করেন। এঘটনায় থানায় মামলাও হয়। অন্যদিকে খাগরিয়ায়ও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আকতার হোসেন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জসিম উদ্দিনের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে প্রায় সময় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। তারা কেউ কাউকে গুলি বর্ষণ করতে দ্বিধা করছেন না। এঘটনায় থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা হয়েছে। এছাড়া নলুয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী লিয়াকত আলীর নির্বাচনী অফিস দু’বার স্বতন্ত্র প্রার্থী মিজানুর রহমান চৌধুরীর লোকজন পুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ তুলেছেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেন মিজানুর রহমান।
এ ব্যাপারে সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আবু তালেব মণ্ডল বলেন, কিছু কিছু এলাকায় বিভিন্ন সহিংসতা হচ্ছে। পাল্টাপাল্টি অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে।
এ ব্যাপারে সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ আবদুল জলিল বলেন, বিভিন্ন ইউনিয়নে নির্বাচনী সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৫টি মামলা হয়েছে এবং ৫/৬টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগগুলো তদন্তাধীন আছে। মামলায় অনেককে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। অন্য আসামিদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শিবলী নোমান বলেন, নির্বাচনী সহিংসতা রোধে স্বাভাবিকের চেয়েও আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণে আরো ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব দলের প্রার্থীরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সমান সুযোগ পাচ্ছেন। কেউ যদি সমান অধিকার পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করে, তা হবে ভিত্তিহীন।