আরিফুল হাসান »
প্রেমশূন্য পৃথিবীতে এক রাতে ঘর থেকে বের হয় সুলেখা। অন্ধকারে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় পুকুরের দিকে। পাশের একটি ঝোপ থেকে দুটি বেজি দ্রুত ছুটে যায় সামনে দিয়ে। দেখা না গেলেও আন্দাজ করতে পারে, বেজিই হবে। এগুলোকে সে দিনের বেলায়ও দেখে। কখনো হামলা করে মুরগির ছানাদের ওপর। ভাতের মাড় ফেলতে ফেলতে হাত পুড়ে, ছ্যাঁকা খেয়ে দৌড় দেয় বেজি তাড়াতে। বেশ নাদুস-নুদুস দেখতে তিনটে মুরগিছানা খেয়েছে এই নতুন মুরগিটা থেকেও। এগারোটি ডিম নিয়ে বসেছিল। নয়টি ফুটেছে। এখন পাঁচটি আছে। একটি নিয়েছে চিলে।
সুলেখা যেতে যেতে ভাবে। কী ভুলটাই না করলাম জীবনে। ‘এই ব্যাডার ভাত খাইতে আইয়া আমার জীবনডা শ্যাষ।’ ভাবনার ঘোরে পুকুরপাড় কাছে চলে আসে। সে ঘাটে নামে। পুকুরের পানিতে হাত ডুবিয়ে বসে থাকে। জল নড়ে ওঠে মাছের ঘাইয়ে। উদ্বিড়ালটা সম্ভবত মাছ খাচ্ছে ওপাড়ে। দুটো অক ঝাঁপিয়ে পড়লো ছাতিম গাছটায়। বিল থেকে মাছ খেয়ে ফিরেছে বোধ হয়। অক দুটোকে সুলেখা চেনে। এক সময় অনেক ছিল এ রকম নিশিবক, এখন এ দুটোই আছে। উদ্বিড়ালটাকেও চেনে সে। সেই বিয়ের পর এ বাড়িতে এসেই তাকে একলা দেখেছে। এখনও একলাই আছে। দিনের বেলায় গাব ও বেতকাঁটা ঝোপের ভেতর ঘুমায়। রাত হলে মাছ মারে। পুকুরের জলের তলে ডুব দিয়ে নেভায় রাতের আগুন। সুলেখার কেমন যেন ভয় পেয়ে ওঠে। বোধ হয় গুইসাপ একটি নামলো পানিতে পাড় থেকে। খুব দ্রুত মুখে-চোখে পানি দিয়ে সুলেখা ওঠে আসে ঘাট থেকে।
বিছানায় স্বামী পাশ ফিরে শুয়ে আছে। সুলেখা জানে, রাতে না ফিরলেও ডাকবে না এ পুরুষটা। কেমন পাষাণ! কী দিয়ে তৈরি সুলেখা জানে। আর জানে বলেই ফিরে এসেছে। এখন পর্যন্ত যুদ্ধ করেই টিকে আছে এ সংসারে। আজো যুদ্ধ করেই টিকবে। সে জানে, বেঁচে থাকার মূল্য অধিক। তাই ফিরে যায় সে ভাতের থালার কাছে, কুপিটা জ্বালায়। মোজাফ্ফর আলী খেকিয়ে ওঠেÑ ‘কেরাসিন কিনতে পইসা লাগে না?’ যুদ্ধে জয় হয় মোজাফ্ফরের। সুলেখা কুপি নিভিয়ে দেয় এক ফুঁয়ে। অন্ধকারে বসে থাকে। আরও রাত নেমে এলে অগত্যা বিছানায় এসে ঘুমায়। পরাজিত হলেও তাকে যে বেঁচে থাকতে হবে।
সকাল হয়। দিনের আলোতে সব ভুলে যায় সুলেখা। খালি পেটে উনুন চড়ায়। রান্নায় দেরি হলে আবার স্বামী-সন্তানের অসুবিধা হবে। রান্না শেষ হলে গরম-গরম ভাত বেড়ে দেয় স্বামী-সন্তানদের মুখে। হয়তো তখন সন্তানদের পীড়াপীড়িতে কিংবা স্বামীর রাগত মুখের দিকে চেয়ে ভাত নেয় নিজের থালায়ও। সুলেখা খায়। চোখের জল তার ভাতের লোকমার সাথে মিশে যেতে চায়। তবু খায়। খাওয়া শেষ হলে উঠানের ধানগুলোকে ছড়িয়ে দেয়। গতকাল মাড়াই করতে-করতে ছুঁইছুঁই সন্ধ্যা নেমে গিয়েছিল। ক্লান্ত সবাই আকাশের দিকে চেয়ে যখন নিশ্চিত হলো, রাতে বৃষ্টিপাত হবার সম্ভাবনা নেই, তখন তারা উঠানেই ধানগুলোকে জড়ো করে রেখে দিয়েছিল। উঠানটা সুলেখা আগেই ভালোমতো লেপেপুঁছে খটখটে করে রেখেছে।
ধানমাড়াই শেষে গা ধুতে পুকুরে নামে মোজাফ্ফর আলী, সাথে দুই ছেলেও। সুলেখা দুই মেয়েকে নিয়ে তাদের পরে এসে গা ধুয়ে যায়। সারাদিন মাঠে-ময়দানে কাজ সেরে এসে ধানমাড়াইয়ে বেশি ক্লান্তি অনুভব করে মোজাফ্ফর। খিদেটা চাগাড় দিয়ে ওঠে। ঘরে মুড়ি আছে কিনা দেখে সে। না, নেই। দোকান থেকে একটা বনরুটি খেয়ে আসবে, ভাবে একবার। না, থাক। ‘দুই ট্যাহা ফাউ-ফাউ চইলা যাইবো’। একটা বিড়ি ধরিয়ে চৌকির কোনায় বসে। দোকানে এমনিতেও অনেক টাকা দেনা। তার ওপর আছে দুই হাজার টাকা ঋণ। ধান বেচে পরিশোধ করতে হবে। কয়েকটা টান দিয়ে মোজাফ্ফর বিড়িটা নিভিয়ে রেখে দেয়। আবার পরে খাওয়া যাবে।
সুলেখা পুকুর থেকে গা ধুয়ে আসে। রান্না বসায়। চুলার উত্তাপে ভাত ফুটতে থাকে। ছেলেমেয়েরা পড়তে বসে। সুলেখা চুলা ফেলে একবার ঘুরে আসে মুরগির খোঁয়াড়টার কাছে। না, ছিটকিনিটা দিয়েছে। তারপর আবার উনুনের মুখে লাকড়ি গুঁজে দিতে থাকে। আগুন লাফিয়ে ওঠে। সুলেখার মনটা কেনো যেন খচখচ করে। মনে হয় শাদা রাতাটা আসেনি খোঁয়াড়ে। বড় মেয়েকে ডাকে। জুলি মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে খোঁয়াড়ের দরজা খুলে দেখে। কুপির আলোয় শাদা রাতাটাকে পাওয়া যায় না। জুলি আবারো খুঁজে। সুলেখাকে জানানোর পর জুলিকে চুলার গোড়ায় বসিয়ে দিয়ে সেও একবার ভালো করে খুঁজে খোঁয়াড়ের এধারে-ওধারে, তন্ন তন্ন করে। না, নেই। বুকটা তার ছ্যাঁৎ করে ওঠে। আশেপাশে খোঁজে সে। না, পায় না। আমগাছে খুঁজে, রাতের অন্ধকারে দেখা যায় না। মোজাফ্ফর তার এভারিটি লাইটে দুইটা অলিম্পিক ব্যাটারি চৌকির তলা থেকে বের করে পুরে নিয়ে আসে। লাইট মেরে রাতের অন্ধকার কেটে-কেটে দেখে, বিলি কেটে দেখে, না, নেই। পুকুরের এপাড়-ওপাড় দেখে, চার পাড় দেখে দুই পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে। সুলেখাও ছোট মেয়েকে নিয়ে কুপি হাতে দেখে ঘরের পেছন, এপাশ-ওপাশ। হদিস নেই। সুলেখার বুক ভেঙে কান্না আসতে থাকে। নিজ হাতে ডিম ফুটার পর থেকে লালন করে বড় করেছে।
রাতাটার মা মুরগিটা কী এক আজব আচরণ শুরু করলো ডিমপাড়ার পর থেকে। নতুন ডিমপাড়া শুরু করেছে, সুলেখা খুশি হয়েছিল। কিন্তু সেটি ডিম পেরেই তা খেয়ে ফেলতো। সুলেখা অনেক পাহারা দিয়েও কোনো ডিম টিকাতে পারেনি। শেষের ডিমটি ভাঙেনি। তবে ডিম পাড়তে যে বসেছিল, সে বসা থেকে আর ওঠেনি। তা দেয়া শুরু করেছিল। সুলেখা নাকে পালক পরিয়ে, পানিতে চুবিয়েও তার তা দেয়ার নেশা কাটাতে পারেনি। ডিমটি সরিয়ে রেখেও দেখেছে, না, মুরগিটি খালি খাঁচাতেই বসে থাকছে। তাই সুলেখা অগত্যা ডিমটি দিয়েছিল তা দিতে। মুরগিটি স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ-সাতদিন বেশি তা দেয়। এই তা দেয়ার সময়টাতে মুরগিটি খুব কম খেতো প্রথম-প্রথম, শেষের দিকে একেবারেই দানা ওঠায়নি চঞ্চুতে। ঠোঁট রাখেনি জলেও। মুরগিটি অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল খুব। শেষমেশ ডিমটি যখন ফুটলোÑ চিওক চিওকÑ সুলেখা খাঁচার কাছে গিয়ে টের পেলো, বোধ হয় অল্প কিছুক্ষণ আগে মুরগিটি মারা গেছে। এখনো শরীরের উষ্ণতা মরেনি।
রাতাটা না পেয়ে মোজাফ্ফরের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে সুলেখার ওপর। সে কেন দেখে রাখেনি ঠিকভাবে? সন্ধ্যার সময় খোঁয়াড়ের দরজা আঁটার সময়ইবা কেন দেখলো না ভালো করে। এইভাবে ভেসে যেতে দিলে যে সংসারের আর কিছুই থাকবে না এবং সংসারের এই অনটনের জন্য সুলেখাকে একপাক্ষিক দায়ী করে মোজাফ্ফর অনেক কথা বলে। সুলেখারও রাতাটার জন্য কম দুঃখ লাগছে না। সে অনুশোচনায় ভোগে। কিন্তু মোজাফ্ফরের বকাবদ্যি এক সময় বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেলে সেও জবাব দিতে বাধ্য হয়। বাবা-মায়ের আকস্মিক ঝগড়ায় কখন যে বড় মেয়ে জুলিও রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসে সুলেখা টের পায় না। ভাত পুড়ে যায়। তখন নিজেকে আর সামলে রাখতে পারে না মোজাফ্ফর। হালের পাজুনটা নিয়ে দুঘা বসিয়ে দেয় সুলেখার পিঠে।
উঠানে ধান ছড়িয়ে দিয়ে সুলেখা গুলতি হাতে বসে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে গেছে। মোজাফ্ফর চলে গেছে মাঠে। একা বাড়িতে সুলেখার মনে হয়, উঠানে অনেক কাক। এত-এত কাক যে সুলেখার একার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না তাড়াতে। সে গুলতি উঁচিয়ে কাকেদের ভয় দেখাতে চায়। ওরা ভয় পায় না। একটি কাক ওড়ে এসে বসে তার গুলতির ওপর।