হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্ তাআলাই সমস্ত প্রশংসার প্রকৃত হকদার, যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, বাঁচার জন্য রুজি দিয়েছেন, আর দিয়েছেন সামগ্রিক সহায়তা। তাঁর পবিত্রতা, যিনি চিরঞ্জীব, তাঁর শানÑহাইয়্যূন, কাইয়ূম। তাঁর সৃষ্টিকূলের সব নশ্বর, ক্ষণস্থায়ী। তিনি সবকিছুর জন্য মৃত্যু ও ধ্বংস অবধারিত করে দিয়েছেন। মৃত্যুর পরে সমাহিত হওয়ার বিষয় রাজা-প্রজাদের সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য করে দিয়েছেন।
আল্লাহ্ এক, অদ্বিতীয়, অনাদি, অনন্ত। তিনি ¯্রষ্টা, পালনকর্তা, রিয্কদাতা। সবকিছুর উত্থানÑপতন তাঁরই নিয়ন্ত্রণে। তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। আমাদের কাছে আল্লাহ্র পরিচয় ও নির্দেশ আনয়নকারী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র বান্দা ও তাঁর রাসূল।
মানুষ সৃষ্ট প্রাণি। ¯্রষ্টা তাঁকে বুদ্ধিÑবিবেচনা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। অন্য সৃষ্টিকে বশীভূত ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা মানুষকে দেওয়া হয়েছে। তাই, সে আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষ রাজাÑবাদশাহ্ হতে পারে কিন্তু সে কারো প্রভু নয়। ক্ষুদ্র আকৃতির মানুষ হাতির ঘাড়ে চেপে তাকে চালনা করতে পারে, কিন্তু তাকে সৃষ্টি করতেও সক্ষম নয়, রিযক দান করতেও নয়। আল্লাহ সমগ্র জাহানের শুধু ¯্রষ্টাই নয়; বরং সবকিছুর পালনকর্তা। মানুষ কারো ¯্রষ্টা নয়। জীবন রক্ষা করাও মানুষের সাধ্যে নেই। যে সৃষ্টি করতে পারে না। রিযক দিতে পারে না, পারে না তার নিজ পছন্দের কাউকে ইচ্ছেমত বাঁচিয়ে রাখতে, মানুষ কেন প্রিয় পোষা পাখিটিকেও পারে না ধরে রাখতে, সে মানুষ প্রভু কী করে হয়? আর যে প্রভু নয়, ¯্রষ্টা নয়, রক্ষাকারীও নয়, সে যাকে ইচ্ছে তাকে প্রাণে মারার ক্ষমতাও রাখে না। মানুষ তো দূরে একটি পিঁপড়ার জীবন ফিরিয়ে দেবার ক্ষমতা কোন রাজার আছে? রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, প্রজারা তাদের বলী হয়। পুরাণকালে এটাই নিয়ম ছিল। সভ্য যুগেও কি তাই? পবিত্র কুরআন আমাদের সামগ্রিক কল্যাণের দিক নির্দেশনা। এতে বলা হয়েছে, ‘ এ পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবকিছুই ধ্বংসশীল। শুধু আপনার প্রবল প্রতাপ ও মহানুভবতার মালিক, প্রভুর মহান সত্তাই বাকি থাকবেন’। আমরাসহ জগতের সবকিছুই ধ্বংসশীল। আমরা চোখে দেখি যে, আমাদের সামনেই প্রিয়জনেরা এক এক করে চলে যাচ্ছেন। যারা আছি, তারাও ধ্বংসের শিকার হবো। এ ধ্বংস ব্যক্তিগত, যতক্ষণ নিজের পালা না আসে ততক্ষণ তা বাস্তবে অনুভব করার সুযোগ নাই। আবার ব্যাপক ধ্বংস হবে একদিন এ পৃথিবীরও, এটাই হবে কিয়ামত বা মহাপ্রলয়। যেখানে এ পৃথিবীই একদিন চুরমার হয়ে খান খান হয়ে যাবে, এরপর ব্যক্তি আক্রোশ মেটাতে অন্যের সাজানো বাগান, ঘরÑবাড়ি, সভ্যতা প্রলয় করার নেশায় সীমিত শক্তির মানুষের এ প্রবণতা, ধ্বংসের উন্মত্ততা, গোটা সভ্যতা ও সভ্যতার মানুষের জন্য বিকারগ্রস্ত উম্মাদের উন্মত্ততা নয় কি?
কোন হিং¯্র প্রাণিই তার স্বজাতি নির্মূলের জন্য ক্রোধোম্মত্ত হয়ে ওঠে না। তাদের মাঝেও ঝগড়া হয়, গুঁতোগুঁতি হয়, কেউ আহত হয়, কিন্তু কোন হিং¯্র বন্য প্রাণি অরণ্যটাই স্বজাতি মুক্ত করতে এমন বেপরোয়াভাবে হিং¯্র হয়ে ওঠে না, যতটা প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ইসরাঈল করছে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের কী করা উচিত? আমরা চাইলেই ফিলিস্তিনের অসহায় মানুষদের বাঁচাতে এক দৌঁড়ে গাজায় পৌঁছে যুদ্ধে যোগ দিতে পারবো না। এটা ওদের পক্ষ থেকেও যুদ্ধ বলা যায় না। অন্যায় আগ্রাসন? তাও এক বাক্যে বলা যাবে না। মানবতাবিরোধী হেন অপরাধ নেই, যা ইসরাইলি জান্তা করে যাচ্ছে না। কোন রাষ্ট্রই তো এখন গ্লোব বহির্ভূত নয়। গ্লোবাল স্বার্থে তাদের নেশার পাগলা ঘোড়ার রাশ টেনে ধরার কোন প্রয়াস কী বিশ্ব মোড়লগণ খুঁজে পাচ্ছেন না। শিশু হত্যা, ধর্ষণ, নিরপরাধ, নিরীহ সাধারণ মানুষের রক্তের হোলি খেলা গণহত্যার চেয়েও উম্মত্ত ধ্বংসযজ্ঞ। স্থাপনা ধ্বংসের মধ্যে কতকিছুই যে ধ্বংস হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। বিশ্বজুড়ে কোথাও বুঝি শান্তি নেই, না শান্তির পক্ষে প্রভাবশালী কোন বিশ্ব নেতৃত্ব? এটা কী অঘোষিত ক্রসেড? ধর্মযুদ্ধে তো নিরস্ত্র লোকের প্রতি অস্ত্র ওঠানো আরো মারাত্মক অপরাধ। সব ধর্মেইতো শান্তির বার্তা আছে। এ কেমন ধর্মবোধ? যেখানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের পৃথিবীতে চিহ্নই রাখা যায় না? বাঁচতে হলে এ অসহায় মুসলিম সম্প্রদায়কে আত্মার সাথে আত্মার বন্ধন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করে নিতে হবে। বাঘ বা সিংহ অন্য প্রাণি শিকার করে ক্ষুধা নিবৃত্ত হওয়া পর্যন্ত। তারপর সে আর শিকারে প্রবৃত্ত হয় না। সে পরিস্থিতিতেও দেখা যায়, লেজে লেজে লাগিয়ে গোল হয়ে বন্য হাতি বা ভিন্ন প্রাণি রক্ষাব্যুহ রচনা করে। মুসলমানরা এখন তাই করবে। একে একে এখন অনেক মুসলিম দেশ প্রতিবাদ করছে, সৈন্য ও যুদ্ধ সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে, আমাদের দেশও পিছিয়ে নেই। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে প্রাণভরে দোয়া করছেন দেশবাসী, তাঁকে নিয়ে গর্ব করছে। মানবতার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে দেখে শান্তিকামী ইহুদীরাও ধ্বংসের হোলিখেলায় উম্মত্ত ইসরাইলীদের ধিক্কার জানাচ্ছে। অপরাধকে আমরা ঘৃণা করি, মানবতার করি জয়গান।
মাহে শওয়াল থেকে হজ্বের মাস শুরু হয়েছে। এরপর থেকে হারাম মাসের প্রারম্ভ। সম্মানের মাস, নিষিদ্ধ মাস, জাহেলী যুগেও যেগুলোতে যুদ্ধ বিগ্রহ হারাম বা নিষিদ্ধ জ্ঞান করা হোত, যে মাসে পরস্পরে ঝগড়াÑবিবাদ, অশ্লীলতা সবই পরিহার করা হোত, সে মাসগুলোতে ইসরায়েল নেমেছে রক্তের হোলি খেলায়। সত্যি, সেলুকাস! এরাই কি নবী মুসা (আলাইহিস সালাম)র রেখে যাওয়া নিরীহ উম্মতের ধর্মÑউত্তরসূরী? এদের কাছেই কখনো এসেছিল আসমানী গ্রন্থ তাওরাতের বাণী? ওরা সভ্যতার সবই কি বিসর্জন দিয়েছে? পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে আসি ফের। মদীনার চির বৈরী বিবাদমান দু’টি গোত্র আউস ও খাযরাজ। রাসূলুল্লাহ (দ.)র আগমনোত্তর তাদের মাঝে সত্যোপলব্ধি জন্ম নেয়। পরস্পরে বিবাদ ভুলে যাঁরা ভাই ভাই হয়ে যায়। ভুলে যায় শতবর্ষের শত্রুতার আক্রোশ। সেই যাদুর ছোঁয়া শান্তির ধর্ম ইসলাম, শান্তির পরশমণি নবী মোস্তফার প্রেমময় অস্তিত্ব। অনেক দিন পর নিছক পার্থিব স্বার্থের দ্বন্দ্ব তাদের মাঝে প্রবল হয়ে দু’ গোত্র ফের যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে ফুঁসে ওঠে। তখন আল্লাহ্র দয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁদের মাঝে আবারো রাসূল এগিয়ে আসেন। নেমে আসে আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ। ‘তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহ্র নেয়ামতকে স্মরণ করো, যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের হৃদয়ে পরস্পরের জন্য প্রেমÑপ্রীতি সঞ্চার করলেন। ফলে তোমরা তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেলে’। (৩:১০৩)
সুরা হুজুরাতের ১০ম আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মুমিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই’। রাসূলে আকরামই হলেন আল্লাহ্র সেই নেয়ামত, যার যাদুস্পর্শের চেয়েও অধিক শক্তিসম্পন্ন চৌম্বিক মায়ার আকর্ষণ তাঁর সাহাবীদের আল্লাহ্র তাওহীদ ও কুরআনের অবিচ্ছেদ্য মায়াজালে সহজেই আবদ্ধ করে নিয়েছিলেন। আল্লাহ্র কুরআন’র আরেক নাম ‘হাবলুল্লাহ’ বা আল্লাহ্র রজ্জু। যার ব্যবহারিক রূপ ‘রাসূল’ নামের অনবদ্য রূপ। যাঁর অদম্য আকর্ষণে অভুক্ত সাহাবী ক্ষুধার জ্বালা ভুলে গিয়ে রাসূল’র নির্দেশ বাস্তবায়িত করতে নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন শত্রুর মাঝে। আমাদের আত্মগত শক্তি তো মূলত রাসূলÑ প্রেম, যা তাঁর সাহাবীগণের উত্তরাধিকারের মত আবহমান কালধারায় এসেছে সকল উম্মতের হৃদয়ে হৃদয়ে, শিরায় শিরায় রক্তধারায়। মুসলমানের মূলমন্ত্র কে না জানে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’। এ কলেমা পড়ে প্রাণে প্রাণে যখন টান পড়ে, ঈমানী বন্ধনে যখন জাগে স্পন্দন, বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক নবী অন্তপ্রাণ তাঁর উম্মত, তাঁর প্রতি ধমনী স্ফীত হয়ে ওঠে, কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে আসে ¯্রষ্টার শক্তিমত্তার মহান জয়গান ‘আল্লাহু আকবর’। সে মুহূর্তে মুমিন বান্দার একটাই পরিচয়, আমরা এক আল্লাহ্র দাসত্ব করি, এ হৃদয়কে ফুল বানিয়ে শ্রদ্ধার অর্ঘ্য দেই নবীজির পায়, যিনি আমাদের এ মন্ত্র শিখিয়েছেন। তখন আমরা শ্বেতাঙ্গÑকৃষ্ণাঙ্গ ভুলে যাই, ভুলে যাই আরব কি অনারব, ভুলে যাই ভাষার বিভেদÑ কে কোথায় আছি বুঝি না, বিশ্বজুড়ে থাকা ময়দানে বদর’র সর্বাধিনায়ক সেই রাসূলে আরবী’র উম্মত আমরা। আমরা আছি, আছি পূর্বে, আছি পশ্চিমেও, আছি উপত্যকায়, আছি মরুর ধুলায়, আছি নদীÑমাতৃক প্রিয় বাংলাদেশে, আছি এশিয়ায়, কি আফ্রিকায়, ইন্দোনেশিয়ায়, তুরস্কে, ইউরোপে। কোথা নেই আমাদের প্রিয়নবীর উম্মত? যে ভাষায় জাগতিক এ জীবনের প্রয়োজনে কথা বলি না কেন, সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র দাসত্ব করে তাঁর নবীরই ভাষায়, সবাই সেই কুরআন খুলে পড়ি, যা হেরার চূড়ায় বাঙময় হয়েছিল। নবী বলেন, ‘মুমিন মুমিনের জন্য এক প্রাচীরের মত, একাংশ অপরাংশকে শক্তি যোগায়। (বুখারীÑমুসলিম) মুমিন জাতিসত্তা অখ- এক দেহের মত, কোন অঙ্গ আক্রান্ত হলে তার ব্যথা অনুভূত হয় সমগ্র দেহে। ইকবালের কথায়, ‘চীন ও আরব হামারা, হিন্দুস্তাঁন হামারা, মুসলিম হ্যাঁয় হাম, ওয়াতান হ্যায় সা-রা জাঁহা হামারা।’ জেগে ওঠো মুসলিম সারা বিশ্ব জাগাও।
লেখক : আরবী প্রভাষক, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।