সুপ্রভাত ডেস্ক »
চলমান সংকটের সমাধানে রুশ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অংশ নিতে বেলারুশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের এক সহযোগী এ তথ্য জানিয়েছেন। আলোচনায় সাড়া দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিও।
রোববার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বেলারুশে শান্তি আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে পরে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর সঙ্গে টেলিফোন আলাপে আলোচনায় সম্মতি জানান তিনি। এরপরই ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা বেলারুশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছেন বলে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের শীর্ষ সহযোগী ও রাশিয়ার প্রতিনিধি দলের প্রধান মেডিনস্কি নিশ্চিত করেছেন।
বেলারুশের স্থানীয় সংবাদ সংস্থা বেলটা নিউজ এজেন্সি বলছে, ইউক্রেন- বেলারুশ সীমান্তের গোমেল অঞ্চলে শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকভ বলেছেন, রাশিয়া আলোচনার জন্য প্রস্তুত এবং ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিদলের গোমেলে পৌঁছানোর অপেক্ষা করছে।
তিনি বলেন, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাথে টেলিফোনে কথা বলেছেন। এরপর প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে কথা বলেন এবং তাকে রুশ প্রতিনিধিদল প্রত্যাহার না করার অনুরোধ জানান। একই সঙ্গে তিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ইউক্রেন গোমেল অঞ্চলে আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক বলে জানিয়ে দেন।
রাশিয়ার প্রতিনিধি দলের আরেক সদস্য লিওনিড স্লাৎস্কি বলেছেন, ইউক্রেনের সাথে আসন্ন আলোচনায় রাশিয়া বেশ ‘কঠোর’ পন্থা অবলম্বন করবে।
এদিকে, বেলারুশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনার পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এক বিবৃতি দিয়েছেন। এতে তিনি বলেছেন, রাশিয়ার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রতিনিধি পাঠাতে রাজি হয়েছে কিয়েভ।
জেলেনস্কি বলেন, ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিদল ইউক্রেন-বেলারুশ সীমান্তের প্রিপিয়াত নদীর তীরবর্তী অঞ্চল গোমেলে কোনো ধরনের আগাম শর্ত ছাড়া রাশিয়ার কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করবেন।
যদিও রোববার সকালের দিকে বেলারুশে রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিতে প্রতিনিধি পাঠাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন তিনি।
ইউক্রেনের এই প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, এমন কোনো দেশের শহর আমাদের জন্য যথাযথ হবে; যাদের ভূখণ্ড থেকে আমাদের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়নি। সৎ আলোচনা এবং সত্যিই যুদ্ধের অবসানের জন্য এটিই একমাত্র উপায়।
এদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। এ সময় তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, কিয়েভ প্রাথমিকভাবে বেলারুশে আসতে অস্বীকৃতি জানিয়ে মস্কোর সাথে আলোচনার বিষয়ে অসঙ্গতি দেখিয়েছে।
ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রাশিয়ার একটি প্রতিনিধি দল প্রতিবেশী বেলারুশের গোমেল শহরে পৌঁছেছে এবং সেখানে তারা ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের জন্য অপেক্ষা করছে।
খারকিভ থেকে রুশ সেনাদের তাড়িয়ে দেওয়ার দাবি ইউক্রেনের
তুমুল লড়াইয়ের পর ইউক্রেনের সেনাবাহিনী দেশটির বৃহত্তম শহর খারকিভে রুশ সেনাবাহিনীর হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছে। শহরটি এখন তাদের এখন পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং আক্রমণকারী রুশ সেনাদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে স্থানীয় গভর্নর দাবি করেছেন।
টেলিগ্রামে ওলেগ সিনেগুবভ বলেন, খারকিভ আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ‘ক্লিন-আপ’ অপারেশনের মাধ্যমে রুশ সেনাদের শহর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তিনি জানান, রুশ সেনারা পাঁচ ও দশজনের গ্রুপে আত্মসমপর্ণ করছে এবং রাস্তার মাঝখানে অস্ত্র ফেলে রাখছে। রুশ শত্রুদের আত্মবিশ্বাস একেবারে ভেঙে গেছে।
এর আগে রবিবার গভর্নর জানিয়েছিলেন, হালকা সামরিক যান নিয়ে রুশ সেনারা শহরে প্রবেশ করেছে। সকাল ৮টার দিকে উত্তর দিকে শহরে প্রবেশ করে। এরপর ইউক্রেনীয় সেনাদের সঙ্গে রুশদের সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে শহরজুড়ে।
তুমুল লড়াই
ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ রাশিয়ার সেনারা ঢুকে পড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কর্মকর্তারা। শহরটির বিভিন্ন সড়কে এখন তুমুল লড়াই চলছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
খারকিভ আঞ্চলিক প্রশাসনের প্রধান ওলেগ সিনেগুবভ জানিয়েছেন, প্রতিরোধ ভেঙ্গে রুশ হালকা সামরিক যান শহরটিতে ঢুকে পড়েছে।
তার বক্তব্যের আগেই একটি ভিডিও ফুটেজে উত্তর-পূর্বের এ শহরটির রাস্তায় বেশ কয়েকটি রুশ সামরিক যান চলাচল করতে দেখা যায়।
সিনেগুবভ পরে এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, রুশ সেনাদের শহরের কেন্দ্রে দেখা গেছে। বাসিন্দাদের ঘরের ভেতর থাকতেও বলেছেন তিনি।
‘আশ্রয়স্থান ছাড়বেন না। ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী শত্রুদের নির্মূল করছে। বেসামরিকদের রাস্তায় না আসতে বলা হচ্ছে,’ বলেছেন তিনি।
রোববার রুশ সেনারা ইউক্রেনের দক্ষিণের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর নোভা কাহোভকা দখলে নিয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো।
শহরটি ছোট হলেও এটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ নিপার নদীর তীরে অবস্থিত।
রুশ সেনারা শহরটির কার্যনির্বাহী কমিটির দখল নিয়েছে এবং বিভিন্ন ভবন থেকে ইউক্রেনের পতাকা নামিয়ে ফেলেছে শহরটির মেয়র ভলোদিমির কোভালেনকোর বরাত দিয়ে জানিয়েছে ইউক্রেনের গণমাধ্যম। খবর ঢাকাপোস্ট, বাসস, বিডিনিউজ।
সমর বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ দিক থেকে অগ্রসর হওয়া রুশ সেনারা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে; যে কারণে নোভা কাহোভকার পর খেরসন, মাইকোলাইভ ও মেলিতোপোলও পতনের মুখে রয়েছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করেছে ইউক্রেন
রাশিয়ার আগ্রাসন বন্ধ করার লক্ষ্যে ইউক্রেন হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে একটি অভিযোগ দায়ের করেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি রোববার এক টুইটার বার্তায় বলেছেন, আগ্রাসনের ন্যায্যতা দিতে গণহত্যার জন্য রাশিয়াকে জবাবদিহি করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, এখনই সামরিক তৎপরতা বন্ধ করার জন্য রাশিয়াকে নির্দেশ প্রদানের একটি জরুরি সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আমরা আদালতে অনুরোধ জানিয়েছি এবং আশা করি আগামী সপ্তাহে বিচার শুরু করা হবে।
ইউক্রেন ছেড়েছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার মানুষ
রাশিয়ার অভিযান শুরুর পর অন্তত ৩ লাখ ৬৮ হাজার মানুষ ইউক্রেনে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এ তথ্য জানিয়েছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেন থেকে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি লোক পালিয়ে পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছে। অন্যদিকে গত তিন দিনে ইউক্রেন থেকে রোমানিয়ায় পালিয়েছে ৪৩ হাজারের বেশি মানুষ।
যুদ্ধে ৪৩০০ রুশ সেনা নিহত
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনের সেনারা। রোববার চতুর্থ দিনের মতো যুদ্ধ চলেছে।
এই যুদ্ধে রুশ ক্ষয়ক্ষতির একটি তালিকা প্রকাশ করেছেন ইউক্রেনের উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী হানা মালিয়া। এক ফেসবুক পোস্টে তিনি দাবি করেন, এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৩০০ জন রুশ সেনা নিহত হয়েছেন। তবে বিবিসি এই দাবির সত্যতা যাচাই করতে পারেনি। রাশিয়াও এখন পর্যন্ত হতাহতের কোনো সংখ্যা প্রকাশ করেনি। ইউক্রেনের মন্ত্রীর দেওয়া তালিকায় ২৭টি বিমান, ২৬টি হেলিকপ্টার, ১৪৬টি ট্যাংক, ৭০৬টি সাঁজোয়া যান, ৪৯টি কামান, ১টি বুক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, ৪টি গ্র্যাড রকেট লঞ্চ সিস্টেম, ৩০টি যানবাহন, ৬০টি ট্যাঙ্কার, ২টি ড্রোন ও ২টি নৌকা ধ্বংসের কথা বলা হয়।
পারমাণবিক অস্ত্র ‘সর্বোচ্চ সতর্ক’ অবস্থায় রাখার নির্দেশ পুতিনের
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন তার বাহিনীর পারমাণবিক অস্ত্রের বহরকে ‘বিশেষ সতর্ক’ অবস্থায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
রাশিয়ার কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র বহরের জন্য এটাই সর্বোচ্চ স্তরের সতর্ক অবস্থা বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।
রোববার টেলিভিশনের এক ভাষণে রুশ বাহিনীর জ্যেষ্ঠ জেনারেলদের উদ্দেশে পুতিন বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার প্রতি বৈরী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ‘বেআইনি নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করেছে। খবর বিডিনিউজের।
আর কেবল পশ্চিমারাই নয়, নেটোর নেতৃস্থানীয় দেশগুলোও রাশিয়াকে নিয়ে আগ্রাসী বক্তব্যে সামিল হয়েছে উল্লেখ করে পুতিন বলেন, এ কারণেই তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং চিফ অব জেনারেল স্টাফকে তার বাহিনীর পারমাণবিক অস্ত্রের বহরকে যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত থাকার আদেশ দিয়েছেন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের এই পদক্ষেপকে পুরোপুরি ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে বর্নণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড সিবিএস নিউজকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এর অর্থ হচ্ছে, পুতিন এমনভাবে রুশ-ইউক্রেইন যুদ্ধের উত্তেজনা বাড়াচ্ছেন যা কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’ ‘আমাদেরকে খুবই তীব্র এবং কড়া ভাষায় এই পক্ষপের নিন্দা করে যেতে হবে’, বলেন তিনি।
পুতিনের এই নিদেশ দেওয়ার অর্থ হচ্ছে, তিনি রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র উৎক্ষেপণের জন্য অনেকটাই প্রস্তুত রাখতে চান। এর মধ্য দিয়ে ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং এর বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের জবাব পারমাণবিক যুদ্ধে গড়ানোর আশঙ্কাও আরও বাড়ল।
পুতিনের নেওয়া পদক্ষেপে রাশিয়ার অস্ত্র উৎক্ষেপণ করা সহজ হল। তবে বিবিসি’র নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা গর্ডন কোরেয়া বলছেন, এই পদক্ষেপের মানে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ইচ্ছা আছে এমন আভাস দেওয়া নয়, বরং এটি নেটোকে সতর্কবার্তা পাঠানোর জন্য রাশিয়ার একটি পন্থা।
রাশিয়ার কাছে বিশ্বের বৃহত্তম পরমাণু অস্ত্রের মজুদ আছে। কয়েকদিন আগেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেইন অভিযান শুরুর সময় হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ‘কেউ এতে বাধা দেওবার চেষ্টা করলে এমন পরিণতি হবে যা তার ইতিহাসে কখনও দেখা যায়নি। ‘তখন অনেকেই একে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি বলেই ধরে নিয়েছিলেন।