জেসমিন আক্তার বাপ্পী »
পৈত্রিক নিবাস কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম’র সোনাপুর গ্রাম হলেও পরাণ রহমানের জন্ম চট্টগ্রামের মাতুলালয়ে – এনায়েত বাজারের মায়া কুটিরে। বাবা সমাজসেবী, মা গৃহিণী। মা বাবার বেশ বড় সংসার এগার ভাই বোনের মধ্যে বড় তিনি। অল্প বয়সে মা হারা। এমনিতর পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন পরাণ রহমান। স্কুলে পাঠ্যাবস্থায় অল্প বয়সে বিয়ে হয় নওগাঁর সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান আয়কর উপদেষ্টা এম. এল. রহমানের সাথে, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সবই ছিল। কিন্তু না, তাতে মজে যাননি পরাণ রহমান। বাবার সংসারে ছোট ছোট ভাইবোনের দেখভাল, নিজের সংসারেও সন্তানÑসন্ততি কিছুই তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। ¯œাতক অবধি পড়া-লেখা করেছেন। এর বাইরে নানা সামাজিক সংস্কৃতি সম্পৃক্ততা তো ছিলই।
পরাণ রহমান যুদ্ধ দেখেছেন, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধের বীভৎসতা দেখেছেন, যুদ্ধাহত সহোদরকেও দেখেছেন,এগার ভাই বোনের সংসার দেখেছেন। আয়কর উপদেষ্টা স্বামী এম.এল. রহমানের মতো অফুরান বিত্ত ও উদার চিত্তের মানুষের সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য সমৃদ্ধি দেখেছেন। কিন্তু এসবে তিনি মোহাবিষ্ট হননি, ভোগবিলাসে মত্ত হননি।
সদ্যস্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি তাঁকে তাড়িত করে। রিলিফ ওয়ার্কে তিনি সম্পৃক্ত হন। না বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত কোন কাজ নয়। ‘ঘাসফুল’ নামক সংস্থার মাধ্যমেই কাজ শুরু করেন। ক্রমশ কাজের পরিধি ও পরিসর বাড়তে থাকে, মহিলাদের সেলাই প্রশিক্ষণ, জন্মনিয়ন্ত্রণে উদ্বুদ্ধকরণ ইত্যাকার কাজের মাধ্যমে। ঘাসফুল চট্টগ্রামের প্রথম অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। পরাণ রহমান অগ্রবর্তী চিন্তার মহীয়সী এক নারী। পরাণ রহমান এতদঞ্চল তথা বাংলাদেশের উন্নয়ন সংগঠকদের মধ্যে পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ; নীতি নির্ধারক, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এমন কি সমাজচিন্তকরা, যা হালে ভাবছেন পরাণ রহমান তা চার দশক আগেই ভেবেছেন এবং সীমিত সামর্থ্য নিয়ে সমাজ প্রগতির ধারাকে বেগবান করেছেন- জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, মহিলাদের স্বাবলম্বী করার জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ দান, ধাত্রী প্রশিক্ষণ, চট্টগ্রাম শহরের সুইপার কলোনি, পটিয়ার কোলাগাঁও’র জেলে সম্প্রদায়, নওগাঁ’র সাঁওতাল এবং ওঁরাও ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীর মাঝে নন ফরমাল প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা কার্যক্রমসহ তাদের জীবনমানবৃদ্ধি ও জীবনদক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যাভিমুখি নানা কার্যক্রম চালুর মাধ্যমে। সমাজের প্রান্তিক, অবহেলিত পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে পদদলিত অবস্থা থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছেন আজীবন- এ ক্ষেত্রে তাঁর সফলতা, স্বীকৃিত, প্রশংসা ঈর্ষণীয়।
পরাণ রহমান বহুজাতিক ক্লাব লায়ন্স ক্ল¦াব, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কমিশনারসহ বহুবিধ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। লেখালেখিও করেছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহ : ১. উপলব্ধির আঙ্গিনায় (ছোট গল্প) ২. একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে (মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ছোট গল্প) ৩. সুবচন সংগ্রহ (সংগৃহীত) ৪. গল্প মঞ্জরী ৫. সৃজনে মননে পরাণ রহমান ৬. তৃণমূলের রমণী ৭. সেলাই সহায়িকা ৮. ছোটদের লেখা শেখা (অপ্রকাশিত) ৯. ছোটদের বর্ণ শেখা (অপ্রকাশিত)
তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাসমূহ ১. ঘাসফুল বার্তা (উন্নয়ন বিষয়ক ত্রৈমাসিক) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ২. একঘর বাঙালী । উপদেষ্টা সম্পাদক , ১৯৬৯-১৯৭২সাল ৩. জায়া (ত্রৈমাসিক), সম্পাদক। ৪. মর্মর (মাসিক) , সম্পাদক। তিনি চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘের সভাপতিও ছিলেন।
পরাণ রহমান তাঁর দীর্ঘ জীবনের কর্মসাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সম্মাননা:
= রাষ্ট্রপতি জনসংখ্যা পুরস্কার, ১৯৯০ সাল
= টিকাদান কর্মসূচিতে সাফল্যের জন্য চট্টগ্রাম বিভাগীয় পুরস্কার, ১৯৯৪ সাল
= ১৯৯৬ সাল পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সেরা এনজিও হিসেবে
= মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী স্বর্ণপদক পুরস্কার, ২০০২ সাল
= চট্টগ্রাম সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ কর্তৃক স্বর্ণপদক, ২০০৩ সাল
= প্রিন্সিপ্যাল আবুল কাশেম সাহিত্য একাডেমী স্বর্ণপদক, ২০০৪ সাল
= মাতৃভূমি পদক ২০০৪, মাতৃভূমি সামাজিক সংস্থা
= মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী স্বর্ণপদক, ২০০৬ সাল
= চট্টগ্রামে কর্মরত এনজিও সমূহ, শ্রদ্ধা ও স্মরণে, ২০২০ সাল
= রোকেয়া পদক ২০২১, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
পরাণ রহমানের সমস্ত কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দু ছিল নারী – নারীর ক্ষমতায়ন ও কুসংস্কার এর অর্গল ভেঙ্গে নারীর অগ্রযাত্রা। তাঁর সংগঠন ‘ঘাসফুল’ এ শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নারীরই সংখ্যাধিক্য দৃশ্যমান। সেটা ঘাসফুল পরিচলানা পর্ষদ এমন কি কর্মকর্তা – কর্মচারী পর্যায়েও। তিনি বরাবরই চাইতেন আপামর জনগণ তথা নারীর হিতার্থেই ঘাসফুলের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। সে নিরিখে ঘাসফুল একটি নারীবান্ধব সংগঠন, জনবান্ধব তো বটেই। তিনি তাঁর সাথে সম্পৃক্ত নারীদের দাপ্তরিক কাজকর্মের খোঁজখবর যেমন রাখতেন তেমনি তাঁদের পারিবারিক -সাংসারিক বিষয়আশয় নিয়েও দেখভাল করতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে চাই, কর্মজীবী নারীদের পারিবারিক জীবন নিয়ে তিনি অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন। তিনি আমাদের উপদেশ দিতেন, কর্ম-পেশা যেমন তোমার জীবন জীবিকার জন্য অপরিহার্য সংসারও তেমনি অপরিহার্য। কাজেই পেশা এবং সংসার দুটোই সমানতালে সমন্বয় করে চলতে হবে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে, বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব, পালা -পার্বণে তিনি ঘাসফুলে কর্মরত মেয়েদের ওই নির্দিষ্ট দিনে অর্ধদিবস পর বিশেষ ছুটি দিয়ে দিতেন যেন মেয়েরা পরিবারে গিয়ে যাবতীয় আয়োজন আনজাম দিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে উপভোগ করতে পারে। আমি ২০১০সালে ঘাসফুলে যোগদান করার পর থেকেই এই বিশেষ সুবিধাটা দেখে এসেছি। আমাদের নিজেদের শারীরিক সুবিধা অসু্িবধা, স্বামী-সন্তান যাবতীয় বিষয়ে সবসময় খোঁজ-খবর রাখতেন দাপ্তরিক কাজকর্মের পাশাপাশি। ২০১২ সালে ১জুন পরাণ আপার জন্মদিনের আয়োজন ছিল ঘাসফুল প্রধান কার্যালয়ে। ঐদিন তিনি সবার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন “ এ হলো আমার ইনফরমেশন মিনিস্টার” – এ কথাটি এখনো আমার কানে বাজে। মনে হয় এখনই এসে আমাকে বলবেন ‘আমার ইনফরমেশন মিনিস্টার’। এ ছিল আমার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও দোয়া। পরাণ রহমান প্রাতিষ্ঠানিক আবহের ভিতরেই একটি পারিবারিক বলয় সৃষ্টিতে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর সেই চেতনাকে ধারণ করেই এখনো আমরা ‘ঘাসফুল পরিবার’ বলেই পরিচিত সকলের কাছে।
১৯৯২ সালে পরাণ রহমান ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি পদ আঁকড়ে না থেকে নতুন নেতৃত্বের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করলেও ঘাসফুলের নীতিনির্ধারণী কার্যক্রম তত্ত্বাবধানে সক্রিয় ছিলেন। বর্তমানে ঘাসফুল দ্বিতীয় প্রজন্মের নেতৃত্বাধীন, পরাণ রহমানের সন্তান আফতাবুর রহমান জাফরী ঘাসফুলের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব নেয়ার পর ঘাসফুলের সেবাসমূহের গতি-পরিধি ও পরিসরের ক্ষেত্রে নতুনতর সংযোজন অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে ঘাসফুলের উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। দেশে বিদেশে খ্যাতি স্বীকৃতি, প্রাপ্তি অর্জনও অনেক। প্রতিনিয়ত পদপিষ্ট ঘাসফুলের নামে নিজ হাতে গড়া সংগঠন ’ঘাসফুল’ সেবার পরিধি পরিসর,খ্যাতি ও অর্জনে জাতীয় পর্যায়ে স্বনামে সুখ্যাতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত দেখেই মানসিক তৃপ্তি, সন্তুষ্টি ও প্রশান্তি নিয়েই পরপারে যাত্রা করেছেন পরাণ রহমান। ‘ঘাসফুল’ তাঁর গৌরব ও গর্বের ধন।
চট্টগ্রাম নগরীর পশ্চিম মাদারবাড়ি এলাকায় স্বল্পআয়ের মানুষের সন্তানদের জন্য ‘ঘাসফুল এডুকেয়ার কেজি স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে ‘ঘাসফুল পরাণ রহমান স্কুল’ নামে চালু রয়েছে। তিনি আমৃত্যু ঘাসফুল এডুকেয়ার কেজি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও অনারারি প্রিন্সিপাল ছিলেন। পূর্ব মাদারবাড়ির সেবক কলোনিতে (মেথর কলোনি) স্থাপন করেন স্কুল পরবর্তীকালে যা ‘ঘাসফুল শিশু বিকাশ কেন্দ্র’ নামে পরিচালিত হয়ে আসছে আজও।
১৯৪০ সালের ১জুন জন্মগ্রহণ করে এই মহিয়সী নারী ৭৫ বছর বয়সে ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পরলোক গমন করেন। বর্তমান প্রজন্মের নারী-ছাত্র-যুবারা পরাণ রহমানের লোকহিতবাদিতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হবেন, এই আশাবাদ রইল।
সুখের বিষয়, খানিকটা দেরিতে হলেও পরাণ রহমানের কর্ম ও সাধনা জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত হয়েছে। সরকার নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য ‘রোকেয়া পদক ২০২১’ প্রদান করে পরাণ রহমানকে।
ঘাসফুল ও পরাণ রহমান হলো আলোকবর্তিকা, আমরা সেই আলোয় আলোকিত।
পরাণ রহমানের সপ্তম মৃত্যুর্বাষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। পরম করুণাময় আল্লাহ তাঁকে জান্নাত বাসী করুন- আমীন!
লেখক : সহকারী ব্যবস্থাপক, পাবলিকেশন্স, ঘাসফুল