অভীক ওসমান »
পূর্বকথা
৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ৭১-এর ২৬ মার্চ পর্যন্ত নাটকের মাধ্যমে আন্দোলন প্রসঙ্গে নাট্যকার মমতাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন ‘মধ্য নিশীতে নীল আকাশকে সামিয়ানা করে জনসভার স্টেজকে মঞ্চ বানিয়ে আমরা হাজারো জনতার সামনে নাটক করেছি।’ সে সময় এক অনতিতরুণ জনসভাসমূহে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে মানুষকে তাপিত ও প্রাণিত করেছিলো। তার নাম- এস.এম. সোলায়মান।
কথোপকথন
উত্তর চট্টগ্রামের দিকে মাঘী শীতের অন্ধকার কেটে গাড়িটা দ্রুত আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে। কালাম আমাকে বলেছিল সোলায়মান তো আমাদের পার্টি করতো না। সে করতো ছাত্র ইউনিয়ন। তো আমাদেরর সাথে তার সঙ্গ বা সংঘ কেমন করে হলো, আমি প্রশ্ন করি। কালাম চৌধুরী তখন বৈজ্ঞানিক ছাত্রলীগ কর্মী।
হলো কী- সোলায়মান করতো হীরা গ্রুপ। মানে চাকসু জিএস শামসুজ্জামান হীরার গ্রুপ। শুনলাম হীরা বিরোধী গ্রুপ তাকে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ধরে নিয়ে যাবে। আমরা বললাম, এ্যাঁ। আমাদের কলেজের ছাত্র যে দলের হোক না কেন বহিরাগতরা ধরে নিয়ে যাবে। কভি নেহি, সোলায়মান ভাই আমাদের সিনিয়র পার্টিজান চট্টগ্রাম কলেজের জিএস মাহবুব ভাই, শহিদ ভাই, নাজিম ভাই, সেলিম ভাইদের বন্ধু। আমরা বাধা দিলাম। সে যাত্রা সোলায়মান রেহাই পেল।
বাংলাদেশের প্রথম হাজার বছরের বাংলা গান
মূলত More than Student Leader সোলায়মান ছিল শিল্পী, গায়ক। নজরুল সঙ্গীত চর্চা করত। পরে আমাদের সাথে ভিড়ে গেল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, কবি ও গীতিকার প্রফেসর আবু হেনা মোস্তফা কামাল ‘হাজার বছরের বাংলা গান’ শীর্ষক একটা গীতি নকশা পারফর্ম করার পরিকল্পনা করছিলেন।
সোলায়মান তা চট্টগ্রাম শহরের, চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র। দুই পাহাড়ের মাঝে মাওলা- চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে তার কী কাম। আমি জানতে চাইলাম।
কালাম : মূলত সোলায়মানের Maximum বন্ধু থাকত ভার্সিটিতে। সে ক্যাম্পাসে যেতো। সোলায়মান, আমাদের সহপাঠি ও ওস্তাদ এ.কে.এম. এমদাদুল হক সেলিম এবং পরিকল্পনাকারী হেনা স্যার গানগুলো তুলেছেন। কিন্তু ভার্সিটিতে এর performance করা সম্ভব হয়নি। পরে চট্টগ্রাম কলেজে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বিবর্তন’ (১৯৭৫) তা করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
Flashback : ১৯৭৫
চট্টগ্রাম কলেজের রেড বিল্ডিংয়ের দোতলায় কালো প্যান্ট সাদা স্লিপ কাটা হালকা পাতলা এস. এম সোলায়মান গান করছেন। কোরাসের তালিম দিচ্ছেন। বাংলা সাহিত্যের এমনকি বাংলা গানের আদিম গান :
এবংকার দিঢ় বাখোড় মোড়িউ।
বিহি বিআপক বান্ধণ তোড়িঅ।।
কাহ্নু বিলসই আসব মাতা।
সহজ নলিনীবম পইসি নিবীত।।
জিম জিম করিয়া করিণিরে রিসঅ।
তিম তিম তথতা মঅগল বরিসই।।
ছড়গই সঅল সহাবে সুধ।
ভাবাভাব বলাগ ন ছুধ।।
দশবল রঅণ হরিঅ দশ দিসে।
বিদ্যা করিকু দম অকিলেসে।।
আধুনিক বাংলায় রূপান্তর :
এবংকার দৃঢ় বন্ধনস্তম্ভ মদিত ক’রে, বিবিধ ব্যাপক (যতো) বন্ধন ভেঙ্গে ফেলে আসবমত্ত (হয়ে) কানু বিলাস করে। (সে) শান্ত হয় সহজ নলিনীবনে প্রবেশ ক’রে। হস্তী যেমন যেমন হস্তিনীতে আসক্ত হয়ে তেমনি মদকল (অর্থাৎ খাদে পতিত হস্তী) তথতা বর্ষণ করে। ষড়গুত সকল (অর্থাৎ যাবতীয় জীব) স্বভাবে শুদ্ধ ভাবে ও অভাবে এক চুলও (কিছু) ক্ষুব্ধ হয় না, অর্থাৎ বিচলিত হয় না। দশদিকে দশবল রত্ন আহরণ ক’রে বিদ্যারূপ হস্তীকে অক্লেশে দমন করে।
বাংলা ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। তবু চর্যাপদের সান্ধ্য ভাষা আমি বুঝি না। তারপর বড়ু চণ্ডীদাস, লালনগীতি, হাছনের গান, ডি.এল.রায়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গান, সবশেষে জীবনানন্দ দাশের ‘হাজার বছর পরে আবার আসিব ফিরে। বাঙলার বুকে আছি দাঁড়িয়ে’ দিয়ে শেষ করা হয় হাজার বছরের বাংলা গান।
সম্ভবত গানগুলো সুর করেছিলেন- আবু হেনা মোস্তফা কামাল। তার সাথে ছিলেন এস.এম. সোলায়মান, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী এ.কে.এম. এমদাদুল হক সেলিম, তপন বৈদ্য, মিলন-চন্দন দুই ভাই। চট্টগ্রামের মিলন এখন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ তবলচী। হাজার বছরের বাংলা গানের মধ্যে একটি আধুনিক গান ছিল ‘আমার ঘরে আগুন লেগেছে, শান্তি নিয়েছে কেড়ে। সে আগুন আমি নেভাতে গেলে শত বাধা আসে তেড়ে’- সোলায়মান এই গানটি প্রায় করতেন। স্বাধীন বাংলাদেশ, আমাদের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার ভাঙ্গনে, হতাশায়, একদলীয় শাসন-বাকশাল, রক্ষী বাহিনীর পীড়ন। গানটি বড় প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছিল। নিজেকে ভীত, সন্ত্রস্ত, অসহায় মনে হচ্ছে। সোলায়মানের জীবনও অনেকটা গৃহদাহের মতো। যতটুকু মনে পড়ে এস.এম. সোলায়মানের পরিচালনায় ‘হাজার বছরের বাংলা গান’ গীতি নকশায় অন্যান্য শিল্পীরা ছিলেন অর্চন বড়ুয়া ইলা, উম্মে সালমা শিলু, রওশন আরা, মালেকা কৃষ্ণা, শামীমা আরো অনেকে। তখন কে জানতো এই গায়ক বাংলাদেশের নবনাট্য আন্দোলনের সৃষ্টি করবে।
মামুনুর রশীদ যেমন বলেন- সোলায়মানের এক জোড়া চোখ ছিলো। সাধারণভাবে বলা হয় চোখ দুটি স্বপ্নিল কিন্তু ওর ক্ষেত্রে তা নয়। চোখ দুটি গীতল এবং সঙ্গীতময়। মনে হয় চোখের পলকেই যেন এককালি গান বেরিয়ে আসবে কণ্ঠে, তার চোখে। চোখ দিয়ে সে সঙ্গীত নির্মাণ করতে পারতো।
সোলায়মানের কণ্ঠে ছিলো ভেজা। ভেজা কণ্ঠের মধ্যেই অবলীলায় ধরা দিতো স্বরলিপি। এই স্বরলিপিগুলিই কালক্রমে ধরা দিয়েছে তার সংলাপে।
সোলায়মানের শিকড় যেহেতু স্বরলিপিতে প্রোথিত, তাই দেখা গেছে একটা প্রবল ঝোঁক তার থেকে গেল গীতল প্রযোজনায়। অনেকটা নরওয়েজিয়ান নাট্যকার ইবসেনের মতো। উল্লেখ্য সে ইবসেনের অনুবাদ করেছিল। গীতি সমৃদ্ধ নাট্যের প্রতি তার আগ্রহ ছিল প্রবল। সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছে সেখানেই। এখান থেকেই বাংলা নাটকের জায়গাটা যেখানে সঙ্গীত দখল করে রেখেছিলো প্রায় সবটাই, সেখানে প্রবেশ করেছিলো সে। বাংলার জনপ্রিয় গানগুলিও দেখা গেছে নাটক থেকেই এসেছে। তা পাশ্চাত্যের ধাঁচে (তখনো সোলায়মান পাশ্চাত্যে যায়নি) সে নির্মাণ করছে এদেশের সহযোগী মিউজিক্যাল। এ আবার গীতিনাট্য নয়, নৃত্যনাট্য নয়। একেবারেই দেহের ভাষা, কোরিওগ্রাফি ব্যবহার করে অভিনয়। Musical demonstration নয়, একেবারেই নাট্যের ব্যবহার। এ কাজ করতে গিয়ে সে খুঁজে বেড়িয়েছে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের নাট্যসম্ভার। তার নাটক ‘ইঙ্গিত’ যখন অভিনীত হচ্ছিলো তখন চারদিকে একটা হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিলো। একদিকে সঙ্গীতের ব্যবহার, ক্ষুরধার সংলাপ, দলগত এবং ব্যক্তিগত অভিনয়, অন্যদিকে অত্যন্ত সময়োপযোগী বিষয়বস্তু আহরণ।
১৯৭২-৭৪ সময়কালের ইন্টাররমিডিয়েট কলেজের (বর্তমান মহসীন কলেজ) ছাত্র নেতা বন্ধু শাহ্ আলম সম্পাদিত কে.পি.এম. কাগজে ছাপা ট্যাবলয়েড সাইজের ছাত্র ইউনিয়নের এক পত্রিকায় সোলায়মানের নাটক ‘শিকল পরিয়ে দাও’ ২য় পৃষ্ঠা থেকে বেশ কয়েক পৃষ্ঠা ছাপা হয়।
‘বিবর্তন’ শেরে বাংলা হোস্টেলে- ১৪২ নং সোলায়মানের কক্ষে, পরে রেড বিল্ডিংয়ে সোলায়ামানের নাটকটি রিহার্সাল শুরু হয়। কিন্তু আমাদের পার্টিজানদের তা মনপসন্দ হচ্ছিল না। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)