শেখ আবদুল্লাহ ইয়াছিন :
আইরা এবার ইশকুলে ভর্তি হয়েছে। প্রথম শ্রেণিতে পড়ে সে। আইরা পড়াশোনায় ভীষণ মনোযোগী। সব সময় ফাস্টবেঞ্চে বসে সে। আইরাদের ক্লাসটিচার হেলেন ম্যাডাম ক্লাসে প্রবেশ করলে শিক্ষার্থীরা তাকে সালাম দিয়ে অভ্যর্থনা জানায়। তিনি সালামের প্রত্যুত্তরে ওয়ালাইকুম সালাম বলে সবাইকে বসার অনুমতি দিলেন। হেলেন ম্যাডাম সবার কাছে জানতে চাইলেন তোমরা সবাই কেমন আছ?
শিক্ষার্থীরা উচ্চৈস্বরে একসঙ্গে বলে ওঠে, ভালো ম্যাম, আপনি?
ম্যাডাম : আমিও ভালো আছি। আজকে তোমাদের সবার জন্য একটা খুশির সংবাদ আছে।
শিক্ষার্থীরা : কি সংবাদ ম্যাম?
ম্যাডাম : আগামী ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু দিবস ও বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে তোমাদের ইশকুল বন্ধ থাকবে।
ইশকুল বন্ধের কথা শুনে সবাই হাততালি দিতে লাগল। হেলেন ম্যাডাম সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন ,
বাচ্চারা তোমাদের জন্য আরেকটা সুসংবাদ আছে।
শিক্ষার্থীরা আবার উচ্চৈস্বরে বলে উঠল, কি সুসংবাদ ম্যাম?
জাতীয় শিশু দিবস ও বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে সেদিন ইশকুলে একটি প্রিিতযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। নৃত্য, গান, চিত্রাঙ্কন, কৌতুক সবকিছু থাকবে এতে। সেদিন অনেক মজা করবো আমরা।
হঠাৎ আইরার সহপাঠী আরশি হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল
ম্যাম, জাতীয় শিশু দিবস কেন পালিত হয়?
সুন্দর একটা প্রশ্ন করেছ আরশি। শোনো বলছি, তোমাদের মত শিশু-কিশোরদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সচেতনতার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিশু দিবস পালিত হয়। ঠিক সেভাবে আমাদের দেশেও জাতীয় শিশু দিবস পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু শিশুদের খুব ভালোবাসতেন।তাঁর জন্মদিনে তিনি শিশুদের সাথে সময় কাটাতেন। শিশুদের প্রতি তাঁর আলাদা দরদ ছিলো, তাই তাঁর জন্মদিবসকে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং সেই থেকে আমরা এদিনটিকে প্রতি বছর জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করে আসছি।
হেলেন ম্যাডাম এবার সবার উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা তোমরা কি কেউ বলতে পার বঙ্গবন্ধু কে ছিলেন? সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেল। একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে।
আইরা তার আম্মুর কাছে বহুবার বঙ্গবন্ধুর গল্প শুনেছে। আইরা হাত তুলে বলল, ম্যাম আমি বলি?
হ্যাঁ বল আইরা, তুমি চেন তাঁকে?
জি ম্যাম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলা হয়।
হ্যাঁ, একদম ঠিক বলেছ আইরা। ভেরি গুড। টেক ইউর সিট মাই গার্ল।
তিনি সকলের কাছে আবার জানতে চান, তোমরা কি তাঁর সম্পর্কে জানতে চাও?
সকলে একসঙ্গে জবাব দিল, জি ম্যাম।
ওকে শোনো তবে। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টঙ্গীপাড়ার শেখ বংশ আলোকিত করে জন্ম নেয় এক ফুটফুটে শিশু। বাবা-মা আদর করে তাঁর নাম রাখেন খোকা। এই সেই খোকাই আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি বাংলাদেশের স্থপতি।
তোমাদের মতো শিশুবয়সে তিনি খুব ডানপিটে ছিলেন। নদীতে সাঁতার কাটা, বানর, কুকুর, কবুতরপোষা, গোল্লাছুট খেলা, ক্রিকেট-হাডুডু খেলা, মাছধরা সবটাই করতেন তিনি। তাঁর প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল।
তিনি দুষ্টু বালকদের নেতা হলেও ছোট এ শিশুটি ছিল মানবদরদি। তার কাছে বিন্দুমাত্র অহংকার বলতে কিছু ছিল না। তিনি সবার সাথে মিশতেন। তিনি তাঁর নিজের বই তাঁর গরিব সহপাঠীকে দিয়ে পড়ার জন্য সাহায্য করতেন। নিজের খাবার অন্যকে ভাগ করে দিতেন। নিজের ছাতা ছাতাহীনদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। নিজে বৃষ্টির মাঝে ভিজে ভিজে আসতেন। একবার ছোটখোকা ইশকুল থেকে আসার পথে এক বুড়িকে চাদর ছাড়া শীতে কাঁপতে দেখায় তিনি নিজের চাদর খুলে বৃদ্ধাকে দিয়ে দেন। শেখ মুজিবুর রহমান মানবদরদির পাশাপাশি অনেক সাহসীও ছিলেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালে একবার তার বিদ্যালয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক পরিদর্শনে আসেন। তাঁর সাথে ছিলেন বাংলার জনপ্রিয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের সামনে দাড়িয়ে ইশকুলের ছাদ মেরামতের দাবি জানান। যে দাবি বিদ্যালয়ের ইশকুলের শিক্ষকেরাও করতে সাহস করেননি তা সেই ছোট বালকটি করেছিল। পরে তার সে দাবি বাস্তবাবায়ন করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী। শেরেবাংলা এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর সাহস দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন এ ছোট্ট বালক একদিন অনেক বড় হবে, হয়েছেও তা।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতার ডাক দিয়ে তিনি মুক্তিকামী বাঙাালিকে পাকিস্তানি দস্যুদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান করেন। তাঁর ডাকে সাড়া দেয় বাংলাদেশের ৭ লক্ষ জনতা। তার ধারাবাহিকতায় নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন একটি লাল-সবুজের দেশ, আমাদের বাংলাদেশ অর্জিত হয়।
সবাই ম্যাডামের কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। তিনি বঙ্গবন্ধুর গল্প শেষ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানতে চাইলেন, বাচ্চারা, তোমরা কে কে এবার প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছ?
সবাই এক এক করে চিত্রাঙ্কন, কৌতুক, নৃত্যে নাম দিলেও গানের তালিকায় কেউ নাম দেয়নি। হেলেন ম্যাডাম বললেন, তোমরা কেউ গানের বিভাগে নাম দেবে না?
সবাই বলল, ম্যাম আইরা খুব ভালো গান গাইতে পারে। তখন ম্যাডাম আইরার কাছে জানতে চাইল, আইরা তুমি প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে না?
ম্যাম, আগে মামণির কাছে অনুমতি নিতে হবে।
সমস্যা নেই। তোমার আম্মুকে আমিই বলব। তুমি গানের বিভাগে নাম দাও।
গান আইরার ভীষণ পছন্দ। আইরার মা লুৎফা বেগম মেয়ের আগ্রহ দেখে ভর্তি করান বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে। সেখানেই আইরা গান শেখে। প্রতিদিন বিকালে মায়ের সাথে গানের ক্লাসে যায় সে এবং সন্ধ্যার আগে ফিরে আসে।
আইরা ইশকুল থেকে ফিরলে মা আইরার কাছে জানতে চাইল, তুমি গানের প্রতিযোগিতায় নাম দিচ্ছিলে না কেন মামণি?
তুমি যদি বকা দাও, তাই।
কি বলে আমার পাগলামিটা, এতে বকা কেন দেব?
কিন্তু মামণি
কিন্তু কি মা?
এত বড় অনুষ্ঠানে সবার সামনে আমি গান গাইবো কীভাবে?
মেয়ের কথা শুনে মা হাসেন। বলেন,
কি যে বলে না আমার পাগলীটা। এখানে ভয়ের কি আছে। তুমি তো গানচর্চা কর। আর মামণি তো আছিই। আমি তোমাকে আরও ভালোভাবে শিখিয়ে দেব। শোনো মামণি, কোনো কাজে ভয় পেতে নেই। সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়, বুঝলে।
হুম, কিন্তু …
কিন্তু কি আবার মামণি?
কোন গানটা গাইব আমি?
তোমার প্রিয় গানটাই গাইবা।
ওকে মামণি, ঠিক আছে।
আজ ১৭ মার্চ। আইরা খুব ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। জাতীয় সংগীত, কোরান তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হল। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে আইরার নাম এলো। আইরা আস্তে-আস্তে কাঁপো কাঁপো পায়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়। মঞ্চে ওঠে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ায় সে। তার হাত-পা কাঁপছে। মায়ের কথা স্মরণ করে সে গান গাইতে শুরু করে :
যদি রাত পোহালে শোনা যেত,
বঙ্গবন্ধু মরে নাই।
যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো,
বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই।
তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা,
আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা
তার গান শুরু হলে পুরো অনুষ্ঠানস্থলে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে। গান শেষ হতে না হতেই সকলের করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠল অনুষ্ঠানস্থল।
বিকালের অনুষ্ঠানের অন্তিম মুহূর্তে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা শুরু করলেন উপস্থাপিকা। গানের ‘ক’ বিভাে প্রথম হয়েছে আইরা। উপস্থাপিকার এমন ঘোষণায় আইরা কিছুটা অবাক হলো। সে মঞ্চে গিয়ে প্রধান অতিথির হাত থেকে পুরস্কার তুলে নেয়।
উপস্থিত সবাই আরেকবার করতালির মধ্যে দিয়ে তাকে অভিবাদন জানায়। আইরা পুরস্কার নিয়ে মঞ্চ থেকে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সূর্য পশ্চিম দিকে অস্ত যাওয়া শুরু করেছে। চারদিকে লালরঙের আভা। লুৎফা বেগম মেয়েকে জিগেস করলেন, মা তুমি না বলেছিলে এত বড় অনুষ্ঠানে গান গাইবে কীভাবে, তোমার নাকি ভয় করবে?
আইরা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো, আমরা করবো জয়, আমরা করবো জয়,
আমরা করবো জয়, একদিন
আহা! বুকের গভীরে আছে প্রত্যয়,
আমরা করবো জয়, একদিন ।
মা-মেয়ে একে অপরের হাত ধরে গান গাইতে গাইতে বাড়ির দিকে রওনা দিল।