আভাসিত

কম্পোজিশন : শিল্পী বিজন মজুমদার

আমজাদ আল মামুন »

শহরের প্রান্তে একটি পুরোনো লাইব্রেরি। জানালার কাচে সন্ধ্যার আলো গলে পড়ে, আর ঘরের ভেতরে বইয়ের গন্ধে একধরনের পুরনো সময় আটকে থাকে। সেই লাইব্রেরিতে কাজ করেন ইলা। বয়স তার তিরিশের কাছাকাছি। মুখে অপূর্ব মায়া, চোখে অসীম এক শূন্যতা যেন কেউ সব কথা জেনে চুপ করে আছে।
ইলা সদ্য স্বামী হারিয়েছেন। শোকের গন্ধ তার চলনে নেই, কিন্তু নীরবতা যেন তার পরিধানে মিশে গেছে। চোখে-মুখে একধরনের আত্মস্থ সৌন্দর্য, যা অতীতের গভীর ক্ষত নিয়েও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি বই ভালোবাসেন, শব্দ ভালোবাসেন, আর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন জীবনানন্দ দাশের কবিতা। অফিস শেষে আর কিছু না থাকুক, ‘রূপসী বাংলা’র একটা পাতায় চোখ না রাখলে যেন তার দিন শেষ হয় না।
শহরের সাহিত্যবৃত্তে যারা ঘোরাফেরা করেন, তাদের মধ্যে ইলার নাম এখন চেনা। ছোট বড় সব পত্রিকায় লেখেন, ফেসবুকেও তার কবিতা ছড়ায়। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে এই শহরের পুরুষ লেখকদের মধ্যেও ইলা যেন এক অদ্ভুত সম্মোহনের নাম। এরা কেউই একে অপরকে খুব একটা প্রশংসা করেন না; বরং ঠান্ডা প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর চুপচাপ উপেক্ষা এদের সম্পর্কের মূল রঙ। কিন্তু ইলার প্রসঙ্গে সবাই যেন অদ্ভুত একভাবে একমত।
“ও যা লেখে… ভয় লাগার মতো। এত পরিণত শব্দচয়ন, এত গভীর অনুভব!”
“জীবনানন্দকে ও কেবল পড়ে না, ভিতরে ধারণ করে।”
“লেখার ছন্দেই একটা অভিজাত বিষাদ কাজ করে।”
এই প্রশংসাগুলো হয়তো আড্ডার ছায়ায় ভেসে বেড়ায়, কিন্তু কারও কলমে তা উঠে আসে না। ইলা যেন একটি অদৃশ্য পীঠস্থান যেখানে সকলে গোপনে মাথা ঠেকায়, অথচ প্রকাশ্যে বলে না কিছুই।
সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। কিন্তু একদিন, কোনো আগাম সংকেত ছাড়াই, শহরের একজন প্রখ্যাত কবি অরুণ ইলার কর্মস্থল ওর লাইব্রেরিতে এসে হাজির হলেন। বয়স তাঁর সত্তুর ছুঁই ছুঁই । দীর্ঘদিনের লেখক, একাধিক বই, কিছু পুরস্কার, কিন্তু মানুষটি নিজে আত্মকেদ্রিক । কেউ বলেন, তিনি অহংকারী; কেউ বলেন, সংযত।
সেদিন তাঁর হাতে ছিল একটি বই নতুন মোড়কে বাঁধাই করা, পরিপাটি। বইটি তিনি ইলার দিকে এগিয়ে দিলেন।
“তোমার জন্য এনেছি,” শুধু এটুকু বলেই দাঁড়িয়ে রইলেন।
ইলা কিছুটা থমকে গেলেন।
“আমার জন্য?”
“হ্যাঁ,” অরুণ হালকা হাসলেন, “বইটা যখন পড়ছিলাম, মনে হলো কবিতাগুলো যেন তোমাকেই বলা। তাই ভাবলাম, কাগজের হাত ধরে কথাগুলো পৌঁছে দিই।”
ইলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বইটি হাতে নিয়ে মাথা হেঁট করলেন। কোনো বাড়তি কথা হলো না। অরুণ চলে গেলেন, ঠিক যেমন এসেছিলেন শান্ত, নিঃশব্দে।
ঘটনাটি ছিল সামান্য, অথচ সেটিই যেন গায়ে পড়ে গেল শহরের সাহিত্যমহলে। কেউ সেটা বলল রসিকতা করে, কেউ একটু ঈর্ষার গন্ধ মিশিয়ে।
“অরুণ তো কাউকেই এমন করে বই উপহার দেয় না,”
“আমার লেখা তো উনি পড়ে বলতেই চান না কেমন লেগেছে।”
“কিন্তু ইলাকে দিলেন। নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু আছে।”
“অথবা বিশেষ কেউ।”
এই কথাবার্তা চলতে থাকে নানাভাবে। কেউ স্পষ্ট কিছু বলে না, তবে আকারে-ইঙ্গিতে এক মৃদু গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।
আর ইলা?
সে সেদিন রাতেই ডায়েরির একটি পৃষ্ঠা ভরে ফেলে
“আজ মনে হলো কেউ একজন না বলেও অনেক কিছু বলে দিলো।
এই বোঝাপড়া, এই নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে রাখা শ্রদ্ধা— খুব বেশি দিন কেউ দেয়নি আমাকে।
বইটা কেবল বই নয়, যেন আমার নিঃশব্দ সময়ের এক চিঠি।
প্রেম নয়, দাবি নয় কেবল বোঝা। শব্দহীন সম্মান।
এই অনুভবের কোনো নাম নেই, তাই আমি কোনো উত্তরও দিচ্ছি না।”
অন্যদিকে, অরুণ নিজের ঘরে বসে চুপচাপ চা খেতে খেতে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকেন। কেউ জানে না তার মনের ভিতর কী কথা ঘুরে বেড়ায়।
তিনি কাউকে বলেন না, কিন্তু মনে মনে হয়তো বলেন “তাকে আমি ভালোবাসি কিনা জানি না। কিন্তু শ্রদ্ধা করি, গভীরভাবে।
তাকে একটা বই উপহার দিয়ে নিজেকে একটু হালকা করেছি এভাবে আমি বোঝাতে চেয়েছি, আমি বুঝি।
প্রেম নয়, প্রত্যাশা নয়। কেবল একটা চুপচাপ উপস্থিতি যা থেকে সে জানবে, সে একা নয়।”
ইলা আর অরুণ কেউ কিছু বলেনি, কেউ কিছু চায়-ওনি। তবু, একটা অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়ে গেছে। শব্দের ওপরে, লেখার বাইরে, এক নিঃশব্দ সান্নিধ্যের গল্প। ইলা এখনো লাইব্রেরির ডেস্কে বসে, পুরোনো বইয়ের পাতায় আঙুল বুলিয়ে যায়। মাঝেমাঝে সেই উপহার পাওয়া বইটির মলাটে একবার হাত রাখেন, আর তারপর চোখ নামিয়ে ফেলেন। কিছু না বলেও যেন সব বলে ফেলেন ভেতরে ভেতরে।
আর অরুণ, দূরে বসে হয়তো ভাবেন, “সে জানুক বা না জানুক, আমি তাকে বুঝেছি এইটুকু থাকুক আমাদের মাঝে।”
এ গল্পের কোনো প্রকাশ্য শেষ নেই। কারণ এই গল্প শব্দ দিয়ে লেখা হয়নি এই গল্প নীরবতায় বলা এক অলিখিত কবিতা।