সুপ্রভাত ডেস্ক »
আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান। গত ১০ দিন ধরে দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে আলোচিত ও সামালোচিত নাম। নিখোঁজ হয়ে আলোচানায় আসা রংপুরের এই যুবকের প্রকৃত নাম আফসানুল আদানান। তিন বছর আগে নাম পরিবর্তনের সঙ্গে নিজের জীবনেও পরিবর্তন আনেন তিনি। নিজেকে ইসলামিক স্কলার দাবি করা ত্ব-হার সেই পরিবর্তনের কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছে বাংলা ট্রিবিউন। একসময়ে চরম ডানপিটে তরুণ কীভাবে আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদানান হলেন, তা জানা গেছে অনুসন্ধানে।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
আবু ত্ব-হা আদনানের বাবা রফিকুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার সারদায়। বাবা রফিকুল ইসলাম রংপুর পাট গবেষণা কেন্দ্রে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে তিনি রংপুরে বিয়ে করেন। ত্ব-হার বয়স যখন ৮ বছর তখন তার বাবা মারা যান। এরপর তার মা আজেফা বেগম দুই সন্তান নিয়ে রংপুর নগরীর সেন্ট্রাল রোড এলাকায় আহলে হাদিস মসজিদ এলাকায় তার বাবার বাড়িতে থাকা শুরু করেন। ত্ব-হা ও তার ছোটবোন জিনাত নানা বাড়িতেই বড় হন। ছোটবোন কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থী। মামারাই তাদের বড় করেছেন।
শিক্ষা জীবন
আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান রংপুর লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও রংপুর সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। পরে রংপুরের কারমাইকেল কলেজের দর্শন বিভাগ থেকে স্মাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। পাশাপাশি রংপুরের জামিয়া সালাফিয়া মাদ্রাসার বিভিন্ন মাওলানার কাছ থেকে আরবি ও দ্বীন শিক্ষা গ্রহণ করেন। তার মামা আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, ত্ব-হা জেনারেলে লেখাপড়া করলেও নিজের ইচ্ছাতে কোরআন, হাদিসহ বিভিন্ন বই-পুস্তাক পড়ে জ্ঞান অর্জন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি আহলে হাদিস সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ইসলামি বই প্রচুর পড়তেন তিনি।
মামা বাড়ির সবাই আহলে হাদিসের অনুসারী
ত্ব-হার মামা খালা আট জন। তার এক মামা একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। অন্য মামারা ব্যবসা করেন। রংপুর নবাবগঞ্জ বাজারে তাদের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো। ধর্মীয়ভাবে তারা আহলে হাদিসের অনুসারী।
ছাত্র জীবনে ক্রিকেটার ও গিটারিস্ট ছিলেন ত্ব-হা
ত্ব-হা ছাত্রজীবনে ভালো ক্রিকেটার ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি ভালো গিটারিস্ট ছিলেন বলে তার স্থানীয় সহপাঠী ও বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। সাইফুল নামে তার এক বন্ধু বলেন, ‘স্কুল ও কলেজে থাকা অবস্থায় নিয়মিত ক্রিকেট খেলতো সে। কখনও কখনও গিটার বাজাতেও দেখা যেতো তাকে।’
মাদকের চিকিৎসার পর পরিবর্তন
ত্ব-হা অনার্সে পড়া অবস্থায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। একসময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তার পরিবার তাকে চিকিৎসা করান। এই সময়টাতে তিনি ধর্মপালনে মনোযোগী হন বলে জানিয়েছেন তার পরিবার ও বন্ধুরা।
ত্ব-হার কর্মজীবন
মূলত ২০১৮ সালের পর ত্ব-হার জীবনে আমূল পরিবর্তন আসে। ওই বছর আলোকিত জ্ঞানী প্রতিযোগিতায় প্রথম রানার আপ হয়েছিলেন তিনি। ত্ব-হা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনও চাকরি বা ব্যবসা করেননি কখনও। মসজিদে নামাজ আদায় করা ও ইসলামী আলোচনাই ছিল তার মূল কাজ। প্রথমে এলাকার মসজিদে ইসলামি আলোচনা করতেন। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন মসজিদে জুমার নামাজে খুতবা দিতেন। এগুলো ভিডিও করে ফেসবুক ও ইউটিউবে প্রচার করতেন। এখান থেকে যে রোজগার হতো তাই দিয়ে চলতো তার। এ ছাড়াও রংপুর নগরীর নিউ ইঞ্জিনিয়ার মহল্লায় প্রজন্ম নামে কোরআন শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। তবে করোনার কারণে প্রায় দেড়বছর ধরে স্কুল বন্ধ রয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব ত্ব-হা
ফেসবুক, ইউটিউবসহ নেট দুনিয়ায় ইসলাম প্রচার করার মাধ্যমেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন আবু ত্ব-হা আদনান। তার ইউটিউব চ্যানেলের নাম–‘আবু ত্ব হা মুহাম্মদ আদনান (Abu Twa haa Muhammad Adnan)’। ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুকেও তার এই নামে পেজ রয়েছে। এছাড়াও ফেসবুকে তার ফ্যান ফলোয়ারদের জন্য পেজ রয়েছে। এসব পেজ দিয়ে ত্ব-হার বক্তব্য প্রচার করা হয়।
২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট ত্ব-হা ইউটিউব চ্যানেল খোলেন। তার চ্যানেলে ৩০টি ভিডিও আপলোড দেওয়া হয়েছে। প্রথম ভিডিও আপলোড দেওয়া হয় ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ। এটি ছিল ২০১৮ সালের ইসলামিক রিয়ালিটি শো ‘আলোকিত জ্ঞানী’র ১৩তম পর্ব। এটিসহ এই বিষয়ে চ্যানেলে তিনটি ভিডিও রয়েছে। বাকি ভিডিওগুলো বিভিন্ন মসজিদে খুতবা প্রদান ও লেকচারের। তার চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার দুই লাখ ৬৩ হাজার। তার ভিডিওগুলোর বিভিন্ন শিরোনাম রয়েছে। এর মধ্যে সমালোচিত হয়েছে, ‘নারীদের অধিকাংশ কেন জাহান্নামে যাবে’। নারীর ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন তিনি। দাবি করেছেন, ‘যে নারী পুরুষের সঙ্গে পাবলিক বাসে উঠে অফিসে যায়, যে নারী সহকর্মী পুরুষের সঙ্গে কথা বলেন, তারা দাজ্জালের বাহিনীর সদস্য। ইমাম মাহাদির বিরুদ্ধে এই নারীরাই যুদ্ধ করবে।’
ত্ব-হার দাবি, পরকালে দোজখে নারীদের সংখ্যা বেশি হবে। প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও ত্ব-হা নানা সময় উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ আছে। এছাড়ার পাশের দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার কথায় দেশের সব সিদ্ধান্ত হয় বলে তিনি বক্তব্য দিয়েছেন।
ত্ব-হার দুই স্ত্রী
আবু ত্ব-হার প্রথম স্ত্রীর নাম হাবিবা নূর। তিনি রংপুরেই থাকেন। তার এই স্ত্রী দেড় মাসের ছেলে ও তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে শালবন মিস্ত্রিপাড়া চেয়ারম্যান গলিতে ভাড়া বাসায় থাকেন। দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিকুন নাহার সারা। তিনি ঢাকার মিরপুর আল ইদফান ইসলামি গার্লস মাদ্রাসার পরিচালক ও শিক্ষক। ত্ব-হা নিখোঁজ হওয়ার চার মাস আগে তাদের বিয়ে হয়েছিল। এই প্রতিষ্ঠানটির পৃষ্ঠপোষক ত্ব-হা নিজেই। তার দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টি তার মা আজিফা বেগম ও প্রথম স্ত্রী হাবিবা নূর জানতেন না বলে জানা যায়।
ত্ব-হাকে বন্ধুদের মূল্যায়ন
ত্ব-হাকে তার রংপুরের বন্ধুরা বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করেছেন। তার বন্ধু আরিফ, সাইফুল, রনির মূল্যায়ন হলো, ২০১৯ সালে ফেসবুকে বিভিন্ন বিতর্কিত ফতোয়া দিয়ে উত্থান হয়েছে ত্ব-হার। ইউটিউব চ্যানেলের কল্যাণে তার পরিচিতি বেড়েছে। বিশেষ করে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তবিরোধী ও নারীবিদ্বেষী ফতোয়া দিয়ে আলোচনায় এসেছেন তিনি।
নিখোঁজ ও ফিরে আসা এখনও রহস্য
গত বৃহস্পতিবার (১০ জুন) বিকাল ৪টার দিকে ৩ সঙ্গীসহ আদনান রংপুর থেকে ভাড়া করা একটি গাড়িতে ঢাকায় রওনা দেন। ঢাকায় এসে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। নিখোঁজের সময় ত্ব-হার সঙ্গে আব্দুল মুহিত, মোহাম্মদ ফিরোজ ও গাড়িচালক আমির উদ্দিন ফয়েজ ছিলেন। তারাও নিখোঁজ হন। নিখোঁজের আট দিনের মাথায় আবু ত্ব-হা আদনান গত ১৮ জুন দুপুরে রংপুর নগরীর মাস্টারপাড়া এলাকার শ্বশুরবাড়ি ফিরে আসেন। পুলিশ তাকে সেখান থেকে সেদিনই উদ্ধার করে হেফাজতে নেয়। ওই দিন রাতে আদালতে জবানবন্দি দেন তিনি। পরে তাকে পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হয়। নিখোঁজ সময়টাতে তিনি তার গাইবান্ধার এক বন্ধুর মায়ের কাছে ছিলেন বলে জানা যায়।
পুলিশের বক্তব্য
রংপুর মহানগর পুলিশের ক্রাইম ডিভিশনের উপ-কমিশনার আবু মারুফ হোসেন বলেন, ‘আবু ত্ব-হা পুলিশকে জানিয়েছেন, ঘটনার দিন রাজধানীর গাবতলী থেকে স্ত্রীর মোবাইল নম্বরে কল দিয়ে সর্বশেষ কথা বলেন তিনি। এরপর মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেন। সেখান থেকে চলে যান গাইবান্ধা সদর উপজেলার ত্রিমোহনীতে এক বন্ধুর বাড়িতে। এরপর থেকে তিনি কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। ব্যক্তিগত কারণে বন্ধুর বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন। এখানে তার সঙ্গে দুজন ছিলেন। তারা হলেন গাড়িচালক আমির উদ্দিন ও মুহিত। অপর সঙ্গী মুজাহিদকে বগুড়ায় রেখে যান। এক সঙ্গীকে নিয়ে অপরজনকে বন্ধুর বাড়িতে রেখে শুক্রবার (১৮ জুন) বিকালে রংপুর মহানগরীর মাস্টারপাড়া এলাকায় শ্বশুরবাড়িতে আসেন আবু ত্ব-হা। তার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে কোনও গোষ্ঠী কিংবা কেউ জড়িত ছিলেন না বলে আমরা ধারণা করছি।’
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন