জাহিদ হাসান হৃদয়, আনোয়ারা সংবাদদাতা »
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথমবারের মতো নদীর তলদেশে গড়ে ওঠা বৃহত্তম সুড়ঙ্গপথ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। যার সংযোগ পথের এক প্রান্ত হচ্ছে শিল্পজোন হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রবেশ পথ আনোয়ারা উপজেলা।
বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের ফলে পাল্টে যাচ্ছে আনোয়ারা, কর্ণফুলী ও পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের জনপথের চিত্র। বিশেষ করে পরিবর্তনের ছোঁয়ায় বদলে যাবে আনোয়ারার অর্থনীতির দৃশ্যপট।
গড়ে উঠছে শিল্পকারখানা
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, টানেল প্রকল্পকে ঘিরে দক্ষিণ চট্টগ্রামে ইকোনমিক জোনসহ বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চলছে। ইতিমধ্যে আনোয়ারায় অবস্থিত কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড), বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বড় সার কারখানা (কাফকো), চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা লিমিটেডে (সিইউএফএল), সাদ মুসা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পার্কের মতো পুরনো কারখানাগুলোর কার্যক্রম সম্প্রসারিত হচ্ছে।
এছাড়াও বঙ্গবন্ধু টানেলের অ্যাপ্রোচ রোড সড়কের কাছাকাছি এলাকায় প্রায় এক একর জায়গা জুড়ে গড়ে উঠছে পোশাক কারখানা এইচ এস কম্পোজিড টেক্সটাইল। আশা করা হচ্ছে, পোশাক কারখানাটিতে তিন থেকে পাঁচ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
পরবর্তীতে কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলায় কারখানা স্থাপনের লক্ষে জমি ক্রয় করেছে দেশের শীর্ষ শিল্প প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপ, ফোর এইচ গ্রুপ, ডায়মন্ড সিমেন্ট, এস আলম গ্রুপ ও পারটেক্স গ্রুপ।
বাড়ছে জমির দাম
বঙ্গবন্ধু টানেলকে ঘিরে ইতিমধ্যে দক্ষিণ প্রান্তে দিন দিন বেড়েই চলেছে জায়গা-জমির দাম। বিশেষ করে টানেল সংযুক্ত সড়কের পার্শ্ববর্তী এলাকার জায়গাগুলোর দাম বছরের মধ্যে বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। বৈরাগ, চাতুরী, বারশত, বটতলী এলাকার জায়গা বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে জায়গা জমি কিনে রাখছেন ব্যবসায়ীরা।
পাল্টে যাচ্ছে সামাজিক অবস্থান
টানেলকে ঘিরে আনোয়ারায় নতুন নতুন শিল্পকারখানার পাশাপাশি গড়ে উঠছে নামি-দামি হোটেল রেস্তোরাঁ। উপজেলার বন্দর কমিউনিটি সেন্টার, সিইউএফএল, চৌমুহনী, বটতলী, কালাবিবির দীঘির মোড়ে তৈরি হচ্ছে উন্নতমানের হোটেল মোটেল। পাল্টে যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায় নাম। টানেলকেন্দ্রিক বিভিন্ন গ্রামের নামকরণ করা হচ্ছে টানেলের সঙ্গে মিলিয়ে। যেমন কিছুদিন আগে গোয়ালপাড়ার নামকরণ করা হয়েছে টানেল নগর।
পর্যটন খ্যাতে আসছে আমূল পরিবর্তন
টানেলের আশেপাশে গড়ে উঠছে নতুন নতুন পর্যটন স্পট। পুরোনো বিনোদন কেন্দ্রগুলোর উন্নয়নের জন্য আসছে নতুন নতুন বাজেট। পারকি সমুদ্রসৈকতে পর্যটন কর্পোরেশনের উদ্যোগে ১৩ দশমিক ৩৬ একর জমিতে ৭১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বিশ্বমানের পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া বটতলীতে তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সৌন্দর্যের সমন্বয়ে মেন্না গার্ডেন নামের নতুন বিনোদন কেন্দ্র যা ইতিমধ্যে সকল পর্যটকের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এছাড়াও উপজেলায় রয়েছে প্যারাবন, হিলটপ পার্ক, ১৫নং ঘাট, মেরিন একাডেমিসহ মনোমুগ্ধকর নানান পর্যটনকেন্দ্র।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসছে অভাবনীয় পরিবর্তন
টানেলের সংযোগ সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করতে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ৪০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে এই টানেল সংযোগ কর্ণফুলীর শিকলবাহা ওয়াই জংশন থেকে আনোয়ারা কালাবিবির দীঘি পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটারের সড়কটি ছয় লেনে উন্নীত করার কথা থাকলেও ভূমি অধিগ্রহণে নানা জটিলতার কারণে আপাতত ৪ লেনের কাজ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে মূল সড়কের ২১টি কালভার্টের কাজ। ফলে আনোয়ারা উপজেলা থেকে সড়ক পথে চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছাতে যেখানে ঘন্টাখানেক সময় লাগতো সেখানে ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছানো যাবে। এ নিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা, চন্দনাইশ, বাঁশখালি এবং কক্সবাজার জেলার পেকুয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, কুতুবদিয়ার যাত্রীদের মধ্যেও স্বস্তি কাজ করছে।
ব্যাংকের শাখা স্থাপনে প্রতিযোগিতা
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও। প্রবাসী রেমিটেন্স ও শিল্প কারখানায় বিনিয়োগ, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সম্ভাবনার দিকে ঝুঁকছে ব্যাংকগুলো। আনোয়ারায় ইতিপূর্বে ১০টি ব্যাংকের শাখা থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে শাখা খুলেছে নতুন আরও ১০টি ব্যাংক। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরও কয়েকটি ব্যাংকের শাখা।
টানেল নির্মাণে আনোয়ারার আর্থসামাজিক অবস্থান কেমন হতে পারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিন বলেন, ‘আনোয়ারা এমনিতে ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এটি অর্থনীতির নাভি হিসেবে কাজ করবে। টানেলের সুবিধা নিয়ে আনোয়ারায় অনেক শিল্পায়ন হবে। স্থানীয় মানুষজনের চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি হবে। টানেলের ফলে আনোয়ারা অঞ্চলে কাঁচামাল ও পণ্য পরিবহন সহজ হবে। এতে করে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট হবে। এছাড়াও সামনে আরও যা মাষ্টার প্ল্যানে আছে তা বাস্তবায়িত হলে আনোয়ারা হবে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার বিনিয়োগের আঞ্চলিক বাজার।’
আনোয়ারা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক চৌধুরী বলেন, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আনোয়ারা মডেল উপশহরে পরিণত হচ্ছে। বিশেষ করে চাতরী-কালাবিবির দীঘি ও আশপাশের এলাকাটি এখন দেখে চেনার উপায় নাই। যেখানে প্রতি গন্ডা জমির দাম ছিল ২ থেকে ৩ লাখ, তা এখন ৩০ লাখের ওপরে। টানেলের ছোঁয়ায় আনোয়ারার তথা দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের যাতায়াত ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। সড়ক দূর্ঘটনায় আহত কিংবা যে কোনো অসুস্থ রোগীকে খুব দ্রুত সময়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কিংবা উন্নত মানের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। সর্বোপরি টানেলের ফলে এখানকার মানুষের জীবনমানের বহুলাংশে উন্নতি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।