সুপ্রভাত ডেস্ক »
‘বাংলাদেশে এসে বুঝেছি, স্বাধীনতা কী জিনিস’- কিছুটা নরম স্বরে বললেন সহপাঠিদের সঙ্গে খেলা দেখতে আসা ইসমায়া। মাঠের অভিজ্ঞতা নিয়ে তার কণ্ঠে উচ্ছ্বাস থাকলেও, নিজ দেশ আফগানিস্তান নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মুখের হাসি উবে গেল এই তরুণীর। তালেবান শাসনে আফগানিস্তানের নারীদের বর্তমান অবস্থাই যেন প্রতিফলিত হলো তার মাঝে।
জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে গতকাল শনিবার ইসমায়ার মতোই আরও প্রায় একশর বেশি ছাত্রী এসেছেন বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের দ্বিতীয় ওয়ানডে দেখতে। সবাই মিলে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে উপভোগ করেন রহমানউল্লাহ গুরবাজ ও ইব্রাহিম জাদরানের সেঞ্চুরি। এর মাঝে কালো ছায়া হয়ে রইল তালেবান শাসনের তিক্ততাও। চট্টগ্রামের গ্যালারিতে নীরব প্রতিবাদ করতেও দেখা গেল ৮ জনের একটি দলকে। খবর বিডিনিউজের।
বাংলাদেশের মাঠে খেলতে এলে যে কোনো দেশকে ভাবতে হয় স্বাগতিক দর্শকদের নিয়েও। কারণ ভরা গ্যালারির সমর্থন বাড়তি প্রেরণা হিসেবে কাজ করে বাংলাদেশ দলের জন্য। কিন্তু শনিবারের চিত্র যেন পুরো ভিন্ন। মাঠে স্থানীয় দর্শকদের আধিক্য থাকলেও সারাক্ষণ আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকা আফগান শিক্ষার্থীদের আওয়াজই পাওয়া গেল বেশি।
দুপুরে খেলা শুরুর আগেই পশ্চিম গ্যালারির একটি ব্লককে যেন এক টুকরো ‘আফগানিস্তান’ বানিয়ে নেন চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন-এর প্রবাসী শিক্ষার্থীরা। প্রায় ১০০ জন ছাত্রী একসঙ্গে আসেন খেলা দেখতে। তাদের নির্বিঘেœ খেলা উপভোগ করে দিতে বাংলাদেশের কোনো দর্শককে সেদিকে ভিড়তে দেননি নিরাপত্তাকর্মীরা।
কেউ ওড়াচ্ছেন লাল, সবুজ ও কালোর সমন্বয়ে গড়া আফগানিস্তানের পতাকা, কেউ বা এঁকে নিয়েছেন গালে। তীব্র গরমের মাঝেও গুরবাজ, ইব্রাহিমের একেকটি বাউন্ডারিতে গর্জে ওঠেন তারা। দুই ওপেনারের আড়াইশ ছোঁয়া জুটির প্রায় পুরোটা সময় দাঁড়িয়েই খেলা দেখেন প্রায় সবাই।
আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মাঝেই বিডিনিউজের সঙ্গে ছোট্ট কথোপকথন সারেন কাবুল থেকে এশিয়ান ইউনির্ভাসিটিতে পড়তে আসা ইসমায়া। ক্রিকেট সম্পর্কে তেমন জানাশোনা নেই তার। তবে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি এই তরুণী।
‘আমি প্রথমবার এসেছি মাঠে খেলা দেখতে। সত্যিই খুব ভালো লাগছে। এখানকার আবহ খুব উপভোগ্য। আমি ক্রিকেট খেলা তেমন বুঝি না। সহপাঠিদের সঙ্গে এসেছি দেখতে। আমাদের দেশ ক্রিকেট খেলছে, সবাই মিলে মজা করছি। এজন্যই মূলত আসা। রশিদ খানকে আমি চিনি। আমাদের বৈশ্বিক সুপার স্টার।’
মাঠে তখন হাসান মাহমুদের ফ্রি-হিট বলে ছক্কা মেরে আশির ঘরে পৌঁছে যান গুরবাজ। সেটির উল্লাস সেরে ইসমায়া তুলে ধরেন বাংলাদেশে থাকার অভিজ্ঞতা। প্রাসঙ্গিকভাবেই সেখানে চলে আসে তালেবান শাসনে নিজ দেশে তাদের ‘পরাধীন’ অবস্থার কথা।
‘এখানে এসেছি ৪ মাসের মতো হয়েছে। খুব ভালো দেশ। প্রথমত, আমরা মুসলমান। বাংলাদেশ এসে বুঝেছি, স্বাধীনতা কেমন হয়। জানো তো, আফগানিস্তানে এখন কী অবস্থা… তালেবানরা সেখানে নারীদের ওপর অনেক বিধিনিষেধ দিয়ে রেখেছে। মেয়েদের পড়ালেখা করতে দেওয়া হয় না, বাইরে কাজ করতে দেওয়া হয় না।’
‘বাংলাদেশ আমার জন্য খুব নতুন। তবে এরই মধ্যে এখানে খুব ভালো লাগছে। খুব ভালো দেশ। আমি যদি উদাহরণস্বরুপ বলি, আমরা এখানে পড়ালেখা করতে পারি, যেখানে খুশি যেতে পারি, যেমন ইচ্ছা জামাকাপড় পরতে পারি। সবসময় মাথায় স্কার্ফ দেওয়ার বাধ্যকতাও নেই। সত্যিই খুব ভালো।’
আফগানিস্তানের একই শহর থেকে আসা নাসির রাওয়ান চেনেন না ইসমায়াকে। তবে ইসমায়ার কথাগুলোই যে নাসিরসহ আফগান নাগরিকদের মনের আকুতি, তা বোঝা গেল ঢাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) থেকে আসা ৮ জনের দলের মাধ্যমে।
গলায় আফগানিস্তানের পতাকা, গায়ে সাদা টি-শার্ট পরে আসেন নাসির ও তার বন্ধু এনায়েতউল্লাহ। টি-শার্টের পেছনে লেখা, ‘লেট আফগান গার্লস লার্ন’- অর্থাৎ আফগান মেয়েদের পড়তে দিন। যে কোনো খেলা যে শুধু খেলার সীমানায়ই সীমাবদ্ধ থাকে না, সেটিই যেন ফুটে উঠল তাদের টি-শার্টের এই বার্তায়।
নাসির, এনায়েতউল্লাহ ও ৬ জন ছাত্রীর এই দলকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে তুরস্কের একটি ফাউন্ডেশন। যারা নারী ও শিশুর মৌলিক অধিকার নিয়ে কাজ করে। কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলে নিজেদের নীরব প্রতিবাদের কথা জানান নাসির।
‘আমরা ৮ জন এসেছি খেলা দেখতে। নিজেদের অবস্থান থেকে আমরা তালেবানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে টি-শার্টে এই বার্তাটি এনেছি। তারা মেয়েদের স্কুলে যেতে বাধা দেয়। এটি করা উচিত নয়। তাদেরও শিক্ষার অধিকার আছে।’
ইসমায়ার মতোই এশিয়ান ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী শাকিলা সুলতানা। বাংলাদেশে আসার আগে একসময় নিজ দেশে তার পরিচয় ছিল পেশাদার বক্সার। কিন্তু সেটি এখন অতীত। চট্টগ্রামের মাঠে রুফটপে খেলা উপভোগ করতে থাকা এই তরুণী জানালেন, সার্বিক পরিস্থিতি চিন্তা করে পড়াশোনা করতে দেশের বাইরে চলে এসেছেন তিনি।
‘আফগানিস্তান নারী জাতীয় দলের বক্সার আমি। অনেক দিন ধরেই বক্সিং করি। আমি দুই মাস আগে বাংলাদেশে চলে এসেছি পড়ালেখা করতে। এখানে প্রথমবার এলাম খেলা দেখতে। তবে আফগানিস্তান ক্রিকেট দলের খোঁজখবর সবসময়ই রাখি। রশিদ খান ও নুর আহমেদ আমার পছন্দের।’
ছাদের ওই গ্যালারি মাতিয়ে রেখেছেন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ও আইইউটির আরও প্রায় পঞ্চাশজন শিক্ষার্থী। যাদের একত্রে রেখে নেতার দায়িত্বে দেখা গেল রহিম সিদ্দিকিকে। কখনও ‘আফ-গা-নিস-তান! আফ-গা-নিস-তান!’, আবার কখনও ‘গুরবাজ! গুরবাজ!’ ধ্বনিতে ব্যস্ত সময়ই কাটছিল আফগানদের এই সুপার ফ্যানের।
গুরবাজ-ইব্রাহিমের জুটি তখন দুইশর কাছাকাছি। সেঞ্চুরি ছুঁয়েছেন গুরবাজ, পঞ্চাশ করেছেন ইব্রাহিম। পানি পানের বিরতিতে ডাকতেই স্বাগ্রহে এগিয়ে এলেন রহিম। খুলে দিলেন নিজের গল্পের ঝাঁপি।
‘আমি এবারই প্রথম বাংলাদেশে এসেছি। তবে খেলা দেখার জন্য প্রায় ৩৫টি দেশে ঘুরেছি আমি। ২০১০ থেকে চলছে আমার এই ভ্রমণ। আফগানিস্তান ক্রিকেট দল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আসার পর থেকেই শুরু করে দিয়েছি এটি। আইসিসির সহযোগী সদস্য থেকে এখন টেস্ট খেলুড়ে দেশ, এই পুরো সফরের সঙ্গী আমিও। যেখানে আফগানিস্তান, সেখানেই আমি (হাসি)।’
মাঠে বাংলাদেশের অবস্থা তখন নাজুক, উড়ছে আফগানিস্তান। এমন অবস্থার মধ্যেও অতিথিপরায়ণ দেশ হিসেবে নিজেদের সুনাম ঠিক রাখতেই হয়তো স্থানীয় এক দর্শক কয়েক বক্স মিষ্টি ও বাকরখানি এগিয়ে দিলেন আফগান শিক্ষার্থীদের সামনে।
এখানেও সবার আগে রহিম। বাংলাদেশের ওই ব্যক্তিকে ধন্যবাদ জানিয়ে খাবারগুলো সবার মাঝে বণ্টন করে দেন তিনি। কিন্তু সেদিকে তেমন মনোযোগ ছিল না কারোরই। গুরবাজ, ইব্রাহিমের ব্যাটিংয়ে বুদ হয়ে খাওয়ার কথাও যেন ভুলে যান আফগান শিক্ষার্থীরা।
সবাইকে ঠিকঠাক মিষ্টি পৌঁছে দিয়ে আবার নিজের কথা বলতে আসেন নিউ জিল্যান্ডে পাড়ি জমানো রহিম।
‘আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডে সুপার ফ্যান হিসেবে আমার নাম নথিভুক্ত আছে। তবে তাদের যথেষ্ট ফান্ডিং নেই। তাই নিজের খরচেই ঘুরি আমি। খেলা দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করলে অন্যদেরও সহযোগিতা করি মাঝেমধ্যে। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা… ঘোরার মধ্যেই থাকি আমি। আমি এর আগে শ্রীলঙ্কা গিয়েছি। পরে নিউ জিল্যান্ড ফিরে দশ দিন থেকেই আবার এখানে।’
আরও কিছু হয়তো বলতে চাচ্ছিলেন রহিম। তবে ততক্ষণে তাকে ঘিরে ধরেন অন্যরা। আবার শুরু হয় গুরবাজ, ইব্রাহিমদের জন্য স্লোগান। চলতে থাকে আফগান শিক্ষার্থীদের আনন্দ-উৎসব।