মিনহাজ উদ্দীন শরীফ :
আদিম তৃতীয় শ্রেণির একজন মেধাবী ছাত্র। তার বাবা একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি চাকরিসূত্রে সিলেটের একটা শহরে থাকেন। আদিম ও মা আজমিরীগঞ্জের একটা গ্রামে থাকে।বাবা প্রতি সাপ্তাহে দু’দিন এসে বাড়িতে থেকে যায়। প্রতি সাপ্তাহের মতো এ সাপ্তাহেও বাবা গ্রামের বাড়িতে আসলেন। তবে এই সাপ্তাহে দু’দিনের পরিবর্তে সাতদিনের জন্য এসেছেন। এ কথাটা শোনামাত্র আদিম লাফিয়ে নাচতে শুরু করল।
বাবা বলল, আদিম, তোমাদের নিয়ে এই সাপ্তাহে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে যাবো।
আদিম বলল, আমরা সিলেটের জাফলং যেতে চাই।
মা বললেন, নাহ আদিম, তোমার বাবা এতদিন পর বাড়িতে আসল তার কাছে এতো সময় নেই। আর তোমারও পড়াশোনার ক্ষতি হবে। আদিমের একটাই দুর্বলতা, কেউ যদি বলে,পড়ালেখার ব্যাঘাত ঘটবে কোথাও বেড়াতে বা ঘুরতে গেলে, তাহলে আদিম আর বাড়ি থেকেই বের হতে চায় না। এক নাগাড়ে শুধু পড়ে আর পড়ে। তাই আদিম তার বাবাকে বলে দিলো,
বাবা, আমার এক্সাম শেষ হলে আমরা জাফলং বেড়াতে যাবো।
বাবা মুচকি হেসে বললেন, আমার ছেলেকে এজন্যই বলি ‘গুডবয়’। আদিম একথা শুনে লজ্জা পেয়ে বন্ধুদের সাথে উদ্যানে খেলতে গেল।
কিছুক্ষণ পর মা আদিমকে ডেকে বললেন, বাবার সাথে বাজারে যেতে হবে। আদিম দৌড়ে এসে হাতমুখ ধুয়ে নতুন জামা পরে বাবার সাথে গ্রামের বাজারের উদ্দেশে একটা রিকশায় ওঠে বসল।
রাস্তায় যেতে-যেতে বাবা আদিমকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কী কী লাগবে?
সে বলল, বাবা আমার কিছু লাগবে না। আগের সাপ্তাহের পেনসিল-রাবার এখনো এক ডজন করে আছে।
এসব কথোপকথন করতে করতে বাবা-ছেলে একসময় বাজারে পৌঁছে গেল।
মায়ের দেওয়া লিস্ট অনুসরণ করে বাবা জিনিসপত্র কিনে ব্যাগে রাখছেন। একে-একে মায়ের দেওয়া লিস্টের সবকিছু কেনা হলো।
পরিশেষে বাবা-ছেলে মাছ বাজারে গেল। সেখানে আদিম বড় বড় মাছ থেকে বাবাকে বলে, বাবা, ওই বড় মাছটা আজ কিনতে হবে! বাবা বলল, খোকা আগে মাছের বাজারটা আমরা পরিদর্শন করি। তারপর বুঝতে পারবো কোন্ মাছটা সবচেয়ে বড়! আর কোন্টা ছোট, তাই না?
আদিম বলল, একদম বাবা। আমি বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা। আগে আমাদের সম্পূর্ণ মাছের বাজারটা পরিদর্শন করা উচিত। তারপরই আমরা নির্বাচন করতে পারব কোন্ মাছটা সবচেয়ে বড়।
হঠাৎ আদিমের নজর পড়ল একজন মাছ বিক্রেতার মাছের ওপর। সেখানে এগিয়ে দেখে ছোট-ছোট জাটকা মাছ।
আদিম তার বাবাকে ডেকে এনে বলল, বাবা এই মাছের নাম তো জাটকা, তাই না? বাবা,বলল, হ্যাঁ, আদিম। এগুলো কিনব নাকি?
আদিম বলল, বাবা বইয়ে পড়েছি জাটকা মাছ ধরা অবৈধ। আদিম ছয়-নয় না ভেবে তার বাবাকে বলল, বাবা পুলিশ আঙ্কেলকে কল দেবো। আপনার মোবাইলটা দিন। বাবা আদিমকে মোবাইল দিলে আদিম পুলিশ আঙ্কেলকে কল দিয়ে জাটকা বিক্রেতার কথা বলল। সে বলল, আমি মাছবাজারে আসছি। বাবা আদিমকে বলল, তোমার পুলিশ আঙ্কেলকে কেন কল দিলা? সে বলল, একদিন আঙ্কেল আমাদের স্কুলে গিয়ে বলেছিল জাটকা মাছ ধরা অন্যায় ও অবৈধ। যখন যেখানে এই জাটকা মাছ দেখবে তখনই আমাকে কল দেবে’। পুলিশ আসামাত্র বাজারে মানুষের ভিড় লেগে গেল।
আদিমকে দেখে পুলিশ অফিসার আজিজ সাহেব বললেন, আদিম, কোথায় জাটকামাছ বিক্রেতা?
আদিম বলল, এই যে দেখুন, আঙ্কেল।
আজিজ সাহেব মাছ বিক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কী জানেন না চাচা, জাটকা মাছ ধরা আইনত অপরাধ। এর জন্য তিন মাসের জেল হবে। তারপরও আপনি জাটকা মাছ বিক্রি করছেন?
সে বলল, বাবারে আমি গরিব মানুষ। জাল দিয়ে মাছ ধরে সেই মাছ বিক্রি করে সংসার চালাই।
মাছ বিক্রেতার মুখে একথা শুনে আজিজ সাহেবের মায়া হলো।
তাই বয়স্ক লোকটিকে থানায় নিয়ে গেলেন না। তবে যাতে আর কোনোদিন জাটকা না ধরে সে পরামর্শ দিলেন। তিনি আরও বললেন, আপনার জালে যদি জাটকা ধরাও পড়ে তাহলেও ছেড়ে দেবেন। হিসাব রাখবেন কতটা মাছ ছাড়া হয়। এর টাকা আমি দেবো। এ কথা শুনে জেলের মুখে হাসির রেখা ভেসে উঠলো। আজিজ সাহেবের এমন মহত্ত্ব দেখে সবাই খুশি হলো। সবাই আজিজ সাহেবের খুব প্রশংসা করলো।
আদিম যে এতটুকু বয়সে এতটা সচেতন, এটা দেখেও বাবাসহ সবাই বিস্মিত হয়েছিল। আজিজ সাহেব খুশি হয়ে আদিমকে সরকারের পক্ষ থেকে দুহাজার টাকার চেক উপহার স্বরূপ দিলেন। আদিম চেক হাতে পেয়ে বলল, পুলিশ আঙ্কেল, শুধু এই গ্রামের মানুষকেই শুধু সচেতন করলে হবে না। দেশের সব মানুষকে সচেতন করতে হবে। এজন্য পরের দিন দৈনিক আজমিরীগঞ্জ পত্রিকায় আদিম এবং আজিজ সাহেবকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলো। এ খবর নিমিষে চারদিকে ছড়িয়ে গেল। তারপর থেকে এ গ্রামের মানুষের পাশাপাশি দেশের সব মানুষই জাটকা ধরা থেকে বিরত থাকল।