বাঙালির মাতৃভাষা রক্ষায় আত্মত্যাগের গৌরবোজ্জ্বল দিন আজ। ১৯৫২ সালের এইদিনে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ১৪৪ ধারা তথা রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দিয়ে মায়ের ভাষার সম্মান রক্ষা করেছেন ভাষা শহিদেরা।
ভাষা আন্দোলন যা ছিল প্রকৃতপক্ষে ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলন, তা পরবর্তীতে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনায় একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষাকে জাগরূক করেছিল। এই আন্দোলন প্রতীক ও চেতনা হয়ে উঠেছিল বাঙালির সকল প্রগতিশীল ও মানবিক আন্দোলনসমূহে; সব ধরনের অপসংস্কৃতি, অপরাজনীতি, ধর্মান্ধতা কূপম-ূকতা, সাম্প্রদায়িকতার প্রতিরোধে একুশের চেতনা প্রেরণা দিয়ে গেছে যুগ যুগ ধরে।
এখন এর গৌরব শুধু বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর বিশ্বের সকল ভাষাভাষির কাছে এই দিনটি নতুন মাত্রা ও মর্যাদার হিসেবে গণ্য হচ্ছে।
ইউনিসেফ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বিশ্বের সকল ভাষার প্রতি মর্যাদা প্রদান করেছে এবং সে সঙ্গে অবলুপ্ত হতে যাওয়া ভাষাগুলোকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশও এই উদ্যোগের বাইরে নয়। রক্ত দিয়ে ভাষার অধিকার আদায়কারী জাতি হিসেবে এটি আমাদের দায়িত্বও বটে।
শিক্ষা ও ব্যবহারিক জীবনে বাংলা ভাষার প্রচলন ও মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করার বিষয়টি সকল মহলে গুরুত্ব পাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানে, সেমিনারে বাংলাভাষাকে অবহেলা করা হয়। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতে ইংরেজির প্রবল দাপট। বাংলা প্রচলনে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থনযোগ্য নয়। তা ছাড়া মাতৃভাষার অশুদ্ধ ব্যবহার, বিকৃত উচ্চারণ ও ভুল প্রয়োগ, বিদেশি শব্দের ঢালাও ব্যবহার বাংলাভাষার সৌন্দর্য হানি ঘটাচ্ছে না কেবল, ভাষাকেও দুর্বল করে দিচ্ছে। বিশ্বায়নের প্রবল চাপে বাংলাভাষাকে অনাদরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আঞ্চলিক শব্দের ঢালাও ব্যবহার প্রমিত ভাষা হিসেবে বাংলাকে জগাখিচুড়ি রূপ দিচ্ছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, আইন ও বিশেষায়িত শিক্ষার জন্য উন্নত অনুবাদ ও পরিভাষার প্রয়োজন রয়েছে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের ভাষা নীতিমালা ও অনুবাদ পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন।
এবার করোনার কারণে একুশের অনুষ্ঠানমালা সীমিত আকারে করতে হচ্ছে। একুশে ফেব্রুয়ারি বইমেলা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে একুশের অনুষ্ঠান ও বইমেলায় অংশগ্রহণ বাঞ্ছনীয়।
আমরা মনে করি ভাষা ব্যবহার ও প্রচলনে আইনি বাধ্য-বাধকতা থাকা প্রয়োজন। বিশ্বপরিসরে বাংলাভাষার চর্চা বাড়ছে। অনেক দেশ বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করছে, প্রবাসী বাঙালিরা পত্র-পত্রিকা, রেডিওতে বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠাণ করছে এশিয়া ইউরোপের অনেক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষার লেখক সাহিত্যিকের, লোকসাহিত্য নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। ব্যবহারের দিক থেকে বাংলা পৃথিবীর পঞ্চম ভাষা। কয়েকটি দেশে ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার হয়েছে। এসবই আমাদের গৌরবের বিষয়। আমাদের দেশের সংখ্যালঘু নৃ-গোষ্টীর ভাষা, সংস্কৃতিকসংরক্ষণে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে, সকলে যাতে মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করতে পারে সে ব্যাপারে প্রচেষ্টা নিতে হবে।
স্বাধীনতার অর্ধশত বছরেও মানুষের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা পূরণ হয়নি। এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য আরো ব্যাপক হয়ে ধরা দিয়েছে। আমাদের দায় ও কর্তব্যও বিরাট, তার প্রতিপালন হোক আমাদের অঙ্গীকার।
আমরা ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। তাদের আত্মদান জাতিকে দেশপ্রেম ও মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগে উজ্জীবিত করুক।