আঁরার দেশহান ফুলর বাগান

শৈবাল চৌধূরী :

মোহাম্মদ হোসেন নিজেকে একজন শিল্পী বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন, রোহিংগা জাত্যাভিমান তাঁর মধ্যে প্রকট। তাঁর দেশ মিয়ানমারের আরাকান (রাখাইন রাজ্য)। তাঁর চোখে সবুজে শ্যামলে মায়াভরা সেরা এক দেশ আরাকান। দিনমজুর মোহাম্মদ হোসেন সুখে-শান্তিতে ছিলেন নিজ দেশে। যে দেশে তাঁর পূর্বপুরুষেরা বসবাস করে গেছে। কিন্তু আজ সব হারিয়ে তিনি পৈতৃকভূমি ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৈরী প্রতিবেশীর নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়ে।

স্বজনদের অনেককে হারিয়ে, প্রাণ বাঁচাতে সঞ্চিত সম্পদের সবটুকু ফেলে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন বাংলাদেশের দক্ষিণ জনপদে। কিন্তু তাঁর প্রিয় ম্যান্ডোলিনটি তিনি কখনোই হাতছাড়া করেননি। অনেক কষ্টে, সযতেœ বুকে বেঁধে নিয়ে এসেছেন তাঁর সর্বক্ষণের প্রিয়সঙ্গী বাদ্যযন্ত্রটি। যেটির তারে-তারে তিনি প্রতিনিয়ত সুর তোলেন আর সুরের সাথে তার বুক থেকে হাহাকারের মতো গান ঝরে পড়ে। যে গান কেবল তাঁর ফেলে আসা প্রিয় মাতৃভূমিকে নিয়ে বাঁধা : ‘আঁরার দেশহান ফুলর বাগান’।

ম্যান্ডোলিনটি তাঁর কাছে কেবল একটি বাদ্যযন্ত্রমাত্র নয়। মোহাম্মদ হোসেন, যাঁকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সকলে শিল্পী আহমদ হোসেন নামে চেনে, তাঁর কাছে বাদ্যযন্ত্রটি ফেলে আসা স্বদেশের অস্তিত্বের স্মারক। প্রায়ই তিনি ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লক থেকে ডাক পান গান শোনানোর জন্যে। তখন প্রিয় ম্যান্ডোলিনে তিনি সুর তোলেন : ‘মননানরে বুঝাইয়ম আঁই কেন্ গরি।’

গানে তিনি দুঃখের কথা, হাহাকারের কথা আর আশার কথা প্রকাশ করেন। সেই আশা তাঁর নিজ দেশে ফিরে যাবার। বুক চিতিয়ে তাই বলেন :

 

ইয়ান আঁর দেশ ন

১০ মিনিটও এন্ডে ভালা ন লাগে

যাইতামগই চাই,

হত সোন্দর আঁর দেশ।

এন্ডে রই দে বিচারর লাই

বিচার অইলে যাইয়ম গই। …

রোহিঙ্গারা বিচার চায় গণহত্যার। তারা মনে করে বিচার হবে। তারপর তারা ফিরে যেতে পারবেন নিজের দেশে।

মোহাম্মদ হোসেনকে কেন্দ্র করে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি নির্মিত হলেও এতে পুরো আরাকানই যেন ওঠে এসেছে। মোহাম্মদ হোসেন হয়ে উঠেছেন আরাকানের প্রতিভূ। ন্যারেটিভ ফর্মে নির্মিত ছবিটিতে সে দেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো অমানবিক অত্যাচার, হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ, তাদের বিতাড়ন এবং পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয়গ্রহণের চিত্র পরিমিত ফুটেজ সংযোজনে মর্মন্তুদভাবে ওঠে এসেছে। বাড়তি কোনো ধারাবর্ণনা ছাড়াই মোহাম্মদ হোসেনের জবানিতে পুরো আখ্যান অনেকটা গল্পের মতো দর্শকেরা শুনতে ও দেখতে পান। মোহাম্মদ হোসেন পুরো সময় জুড়ে হাস্য-কৌতুকের ছলে তাঁর এবং তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা অবলীলায় বলে গেছেন। পরিচালক এক্ষেত্রে নেপথ্যে সঞ্চালনার ভূমিকা পালন করেছেন। মোহাম্মদ হোসেনের স্বতঃস্ফূর্ততা ছবিটিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। অমলিন বদনে তাঁর বলে যাওয়া কথা, গেয়ে যাওয়া গান বুকের ভেতরের চাপাকান্নাকে প্রকাশ করেছে যথামাত্রায়। অনেকটা যেন সিরিও কমিক ধরনের।

এক্ষেত্রে অবশ্যই পরিচালকের মুনশিয়ানার কথা বলতে হয়। নিশ্চয় একটি পূর্বনির্ধারিত চিত্রনাট্য ছিল, তবে তাৎক্ষণিক চিত্রায়ণ এবং কেন্দ্র-চরিত্রের তাৎক্ষণিক বয়ান নতুন এক চিত্রনাট্যের জন্ম দিয়েছে, যা সুগ্রথিত হয়েছে গতিশীল সম্পাদনার গুণে। যে কাজটি পরিচালক নিজেই করেছেন। একটা বিষয় পুরো ছবি জুড়ে লক্ষণীয়, তরুণ ও যুবপ্রজন্মের মনে হতাশার ছায়া। তাদের ভাবলেশহীন মুখ ও উদাস অনিশ্চিত দৃষ্টির মিড ও ক্লোজশটের মাধ্যমে পরিচালক মাঝে-মাঝেই তা বুঝিয়ে দিয়েছেন, যা মন্তাজের ভূমিকা পালন করেছে। দুই কিশোর যখন আপনমনে গান ধরে :

‘এনভিসি কার্ড লইতাম ন,

বাঙালি অ অইতাম ন,

আঁরার দেশত আঁরা যাইঅম,

এ দেশতঅ থাইকতাম ন’

গানটি যেন পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মর্মবাণীরূপে ধ্বনিত হয়। রোহিঙ্গা শিশু-যুবা-বৃদ্ধ সকলেই ফিরে যেতে চান নিজের দেশ আরাকানে। যার নামটিও পাল্টে দেয়া হয়েছে সূক্ষ্ম রাজনীতির কূটকৌশলে, বিশেষ একটি জনগোষ্ঠীর নামেÑ ‘রাখাইন’। এরা এনজিও কার্যক্রমের কূটকৌশল সম্পর্কেও সচেতন। সকলের বক্তব্য একজনের জবানে প্রতিধ্বনিত হয় :

‘ইয়ান আঁরার দেশ ন,

যাইতামগই চাই’।

ডিটেলসের ব্যবহারও চমৎকার। জীবনযাপনের নিত্য নৈমিত্তিক চিত্র, বর্ষাতে কষ্ট, অতি ঘনবসতি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রোহিঙ্গাদের অনীহা, ঈদ ও পূজা ইত্যাদি বিভিন্ন অনুষঙ্গের মধ্য দিয়ে পুরো ক্যাম্পজীবনের অসহায়তা চিত্রিত হয়েছে ছবিতে। শরণার্থী শিবিরের অমানবিক-অসহায় জীবন ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন। এ বিষয়ে ১৯৭১-এ এই নিবন্ধকারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অত্যন্ত করুণ। এই ছবিটি দেখে আমার সেই অতীত জীবনের স্মৃতি চোখে ভেসে উঠছিল বারবার। যে অতীত আজও বর্তমান বাংলাদেশে, ফিলিস্তিনে, সুদানে, ভুমধ্যসাগর তীরবর্তী ইউরোপে, লিবিয়ায় দেখতে পাওয়া যায়।

অক্ষর সুবিধাবঞ্চিত মোহাম্মদ হোসেন শৈশবেই অনাথ। নিজের জ্ঞানবুদ্ধি অভিজ্ঞতায় গান বাঁধেন, সুর দেন, গান আপনমনে, শোনান অন্যদেরও। এত জীবনহীনতার মধ্যেও তাঁর সুর জীবনের সুর হয়ে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় রিফিউজি ক্যাম্পের ব্লক থেকে ব্লকে। তাঁর গান প্রতিটি রোহিঙ্গার জীবনের গান। মোহাম্মদ হোসেন যখন আপনমনে বলেন :

‘বেশাবেশি দিল্ জ¦লের,

বেশাবেশি দিল্ কান্দের…

প্রতিটি রোহিঙ্গার মর্মবেদনা হয়ে তা ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ে, ছড়িয়ে পড়ে নাফ নদীর পূর্ব পাড়েও।

হাজার বছর ধরে আরাকান প্রদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা আজ এক দিশাহীন, উদ্দেশ্যবিহীন, ভবিষ্যৎহীন জাতিতে পরিণত হয়েছে। স্বভাবতই হতাশাবোধের কারণে তারা নানারকম অনৈতিক কাজেও জড়িয়ে পড়ছে। অপরাধ জগতে ঢুকে পড়ছে। এটা সব ক্যাম্পেই হয়, সব দেশেই হয়। সুস্থ স্বাভাবিক ও কর্মময় জীবনযাপনের সুযোগের অভাবে এটা হয়। এর পরিত্রাণ একটাই। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। কিন্তু এটা ক্রমশই জটিল ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গারাও এটা বোঝে। তাই মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘ক্যাম্প জীবন অশান্তির বাগান।’ ছবি শেষ হয় তাঁর গানের রেশ ধরে, ‘মাঝি পার কর রে’। এই গান আমাদের সকলের গান হয়ে প্রতিধ্বনিত হয়, ‘পার কর রে।’

‘এ ম্যান্ডোলিন ইন এক্জাইল’-এর প্রযোজক বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। ছবির সংগঠনের সকলেই এদেশের চলচ্চিত্র সংসদকর্মী। চিত্রনাট্য রচনা, মূল চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা ও পরিচালনায় রফিকুল আনোয়ার রাসেল। যিনি নিবেদিতপ্রাণ একজন চলচ্চিত্রকর্মী। দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্র বিষয়ক কর্মকা-ে বিভিন্নভাবে সংযুক্ত। শিক্ষকতাও করেছেন এ বিষয়ে। সহনির্মাতা (কো-ডিরেক্টর) সুজন ভট্টাচার্যও দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্রনির্মাণ ও চর্চার সঙ্গে একনিষ্ঠভাবে যুক্ত। নির্বাহী প্রযোজক এন রাশেদ চৌধুরীও একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা। নির্মাণ সহযোগী জুনায়েদ রশিদ, সিপ্ত বড়–য়া, মোহাম্মদ কায়সার, মো. শওকত হোসেন এঁরা সকলেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বকৃতী। মোহাম্মদ হোসেনের বাজানো ম্যান্ডোলিনের সুরকে ছবির আবহে সুন্দরভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে।

এ ছবি করার মাঝপর্যায়ে পরিচালক রাসেলের কর্কটরোগ ধরা পড়ে। তারপরেও অদম্য স্পৃহায় তিনি ছবিটি শেষ করেছেন এবং অনলাইনে মুক্তি দিয়েছেন ২০২০ সালে। এখন তিনি অনেকটুকু সুস্থ। আমরা তাঁর আশু আরোগ্য এবং কর্মময় জীবন কামনা করি।