অ্যান্টিবায়োটিক যেকারণে চিন্তা বাড়াচ্ছে!

সুপ্রভাত ডেস্ক »

অন্ত্রে যত বৈচিত্র্যধর্মী ব্যাকটেরিয়া থাকবে, সেটি দেহের জন্য তত উপকারী। কিন্তু প্রতিবার অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের ফলে অন্ত্রে থাকা ব্যাকটেরিয়ার বৈচিত্র্য নষ্টের সম্ভাবনা থাকে। কেননা অ্যান্টিবায়োটিক রোগ-বালাই সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াই শুধু ধ্বংস করে না। পাশাপাশি অন্ত্রে থাকা অন্য ভালো ব্যাকটেরিয়ার উপরও নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে।

মানবদেহে রয়েছে অগণিত ব্যাকটেরিয়ার বসবাস। দেহের সার্বিক কার্যক্রমের জন্য এগুলো বেশ জরুরী। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যাকটেরিয়া থাকে অন্ত্রে। তবে প্রতিনিয়ত অ্যান্টিবায়োটিকস গ্রহণের ফলে স্থায়ীভাবে অন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করা হয়। এই ধারণা আসলে কতটুকু বিজ্ঞানসম্মত? খবর বিবিসির।

অন্ত্র দেহের সার্বিক কার্যাবলী সম্পাদনের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন, দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে শুরু করে হজমে সাহায্য করা অঙ্গটির প্রধান কাজ। তবে বহু বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্ত্রের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক হুমকিস্বরূপ।

মূলত ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকেরা অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের পরামর্শ প্রদান করেন। তবে এক্ষেত্রে এটি রোগ নির্মূলের ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসের সাথে সাথে দেহের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাকটেরিয়াও ধ্বংস করে ফেলে। তাই বর্তমানে চিকিৎসার ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ৬৫ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে মূলত দুটি সমস্যার তৈরি হয়েছে। প্রথমত, এটি ধীরে ধীরে অন্ত্রের ক্ষতিসাধন করছে। দ্বিতীয়ত, এটি ব্যবহারের ফলে দেহে অ্যান্টিবায়োটিকের বিপরীতে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধী ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ সম্পর্কে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ মেডিসিনের গৌতম ডানটাস বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকগুলি অন্ত্রের জটিল ইকোসিস্টেমকে ব্যাহত করে। ফলে সেখানে থাকা ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী জিনের ঝুঁকি তৈরি হয়।

অন্ত্রে যত বৈচিত্র্যধর্মী ব্যাকটেরিয়া থাকবে, সেটি দেহের জন্য তত উপকারী। কিন্তু প্রতিবার অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের ফলে অন্ত্রে থাকা ব্যাকটেরিয়ার বৈচিত্র্য নষ্টের সম্ভাবনা থাকে। কেননা অ্যান্টিবায়োটিক রোগ-বালাই সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াই শুধু ধ্বংস করে না। পাশাপাশি অন্ত্রে থাকা অন্য ভালো ব্যাকটেরিয়ার উপরও নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে যেয়ে গৌতম ডানটাস বলেন, ‘ধরুন, বনে আপনি একটি আগাছার সংক্রমণ থেকে মুক্তি পেতে চান। এক্ষেত্রে পুরো বনটিকে কার্পেট বোম্বিং করে বনের ভালো খারাপ সবকিছুই ধ্বংস করে ফেললেন। এক্ষেত্রে সমাধানটা যেমন হবে অ্যান্টিবায়োটিক মানবদেহে সেটিই করে থাকে।’

অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের পর দেহের মাইক্রোবায়োমে এর প্রভাব সম্পর্কে বহু পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে দেখা যায়, অ্যান্টিবায়োটিক মাইক্রোবায়োমের বৈচিত্র্যপূর্ণ অবস্থার যে ক্ষতিসাধন করে, তা কয়েক মাসের মধ্যে অনেকাংশেই পুনরুদ্ধার হয়ে যায়। কিন্তু দেহের জন্য কিছু ভালো ব্যাকটেরিয়া আর কখনোই পুনরুদ্ধার হয় না।

এ বিষয়ে ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনের কোলোরেক্টাল সার্জন কনসালটেন্ট জেমস কিনরস বলেন, ‘কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক তাদের মাইক্রোবায়োমের ক্ষেত্রে বেশ সংবেদনশীল। এক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের ফলে তাদের মাইক্রোবায়োমের বাস্তুসংস্থান উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়। একইসাথে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা আগে যেমনটা ছিল, সেটি আর পূর্বের অবস্থায় থাকে না।

যদিও বিজ্ঞানীরা এখনও অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যগত পরিণতি ঠিক কেমন, সেটি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে মাইক্রোবায়োমের বৈচিত্র্য নষ্টের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে ফেলার ঝুঁকির বিষয়টিও আলোচিত হচ্ছে।

এ সম্পর্কে গৌতম ডানটাস বলেন, ‘আমরা যখন প্রতিবার অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করি, তখন এটি অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স জীন বৃদ্ধি করতে পারে। তাই একজন ব্যক্তি পরবর্তীতে যখন রোগে আক্রান্ত হন, তখন রোগটি অন্ত্র থেকে নির্দিষ্ট কিছু ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স জিনের সহায়তা পেতে পারে।’

এ সম্পর্কে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইভুল্যাশন অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক ক্রেইগ ম্যাকলিন জানান, রোগ সৃষ্টিকারী প্যাথোজিনের সাথে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স জিনের সংশ্লিষ্টতা শুধু অন্ত্রের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং এটি দেহের অন্য প্রান্তেও ছড়িয়ে পরে। তাই অন্ত্রে যা ঘটে, সম্পুর্ণ শরীরে তার প্রভাব দেখা যায়।

একদিকে ক্ষতিকারক আর অন্যদিকে জীবন রক্ষাকারী ভূমিকা থাকায় বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীরদের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। যদিও অ্যান্টিবায়োটিকের নেতিবাচক প্রভাব ঠেকাতে নির্দিষ্ট কোনো সমাধান নেই। তবে বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষতিকারক প্রভাব অনেকাংশে কমানো যেতে পারে।

এ সম্পর্কে কিনরস বলেন,অ্যান্টিবায়োটিক বেশ কার্যকরী একটি মেডিসিন; যা কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। এটা বেশ মূল্যবান সম্পদ এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে এর ব্যবহার চালিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্ত দেহে এটি ব্যবহারের আগে আমাদের বুঝতে হবে এটিকে কীভাবে আরও সঠিক ও সুনির্দিষ্টভাবে ব্যবহার করা যায়।

অধ্যাপক ক্রেইগ ম্যাকলিন জানান, অ্যান্টিবায়োটিককে দেহে কীভাবে আরও সুনির্দিষ্টভাবে ব্যবহার করা যায় বিজ্ঞানীরা সেটি নিয়ে কাজ করছেন। এক্ষেত্রে এটি শুধু ঐ ব্যাকটেরিয়াকেই ধ্বংস করবে, যেটি দেহের ক্ষতি করছে। কিন্তু অন্ত্রের জন্য উপকারী অন্যান্য ব্যাকটেরিয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে না।

অন্যদিকে লীডস ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক অ্যান্টনি বাকলি জানান, অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে বাঁচতে উপযুক্ত খাদ্য গ্রহণ সব বেশি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। দেহে বৈচিত্র্যপূর্ণ মাইক্রোবায়োম তৈরির পেছনে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ বেশ উপকারী।

লীডস ইউনিভার্সিটির স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত ইনফেকশন রিসার্চ গ্রুপ গত দুই দশক ধরে মাইক্রবায়োমে অ্যান্টিবডির প্রভাব নিয়ে পরীক্ষা করছেন। এ সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়টির মেডিসিন অ্যান্ড হেলথ ফ্যাকাল্টির রিসার্চ ফেলো ইনেস মৌরা বলেন, ‘আমরা যত ভিন্নধর্মী খাবার খাবো, সেটি আমাদের অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমে তত বেশি বৈচিত্র্য আনতে সাহায্য করবে। এক্ষেত্রে ফাইবার জাতীয় খাদ্য সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে পারে।’

ইনেস মৌরা বর্তমানে মাইক্রোবায়োমে ভিন্নধর্মী পুষ্টির প্রভাব নিয়ে কাজ করছেন। একইসাথে এগুলো কীভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের নেতিবাচক প্রভাবকে প্রশমিত করে, সেটি নিয়েও গবেষণা করছেন।

খাদ্যে থাকা ফাইবার দেহের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এটিকে দেহের মাইক্রোবস হজম করে এবং শর্ট চেইন ফ্যাটি এসিড তৈরি করে। ফলে কোলনের পৃষ্ঠে থাকা কোষগুলো শক্তি পায়।

ইনেস মৌরা জানান, আপনি যখন অ্যান্টিবায়োটিকস গ্রহণ করবেন, তখন সেটি মাইক্রোবসে থাকা শর্ট চেইন ফ্যাটি অ্যাসিডকে হ্রাস করে ফেলে। স্বাভাবিকভাবে এটি পুনরায় তৈরি হতে সময় লাগে। এক্ষেত্রে আমাদের তত্ত্ব এই যে, ফাইবারজাতীয় খাদ্য গ্রহণের ফলে মাইক্রোবসে দ্রুত শর্ট টাইম ফ্যাটি এসিড তৈরি হয়। এতে মাইক্রোবস অনেকটা আগের অবস্থায় পৌঁছে যায়।

প্রতিবার অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের বিড়ম্বনা হলো, এটি দেহে সংক্রমনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সক্ষমতা কমিয়ে দেয়। একইসাথে অল্প অসুখেও অ্যান্টিবায়োটিকসের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে দেয়।

এ সম্পর্কে কিনরস বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিকের উপর নির্ভর না করাই ভালো। বরং এর পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের উপর গুরুত্ব দিন। বিশেষ করে একজন কম বয়স্ক ব্যক্তির জীবনে এটি বিশেষভাবে অবলম্বন করা উচিত। কেননা তখন অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণে বেশ ক্ষতি করে থাকে।’