শুভ্রজিৎ বড়ুয়া »
দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রথম স্থাপনা হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। নদীর তলদেশে টিউব বসিয়ে এ টানেলে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের পর দিন থেকে টানেলে যান চলাচল করবে।
এতে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আনোয়ারা উপজেলা। নতুন শহরে রূপান্তরিত হওয়া আনোয়ারা হবে অর্থনৈতিকভাবে সম্বৃদ্ধ। দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক বিনিয়োগসহ পর্যটন খাতে এক অপার সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীসহ বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, ২০১৩ সালে কারিগরি সমীক্ষার পর ‘কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহু লেনবিশিষ্ট সড়ক টানেল নির্মাণ’ শীর্ষক মেগাপ্রকল্প সরকার অনুমোদন করে। পরবর্তী বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বেজিংয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয় এ বিষয়ে। ২০১৫ সালের ৩০ জুন নির্মাতা চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন এন্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (সিসিসিসি) সঙ্গে চুক্তি সই হয়। এরপর ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে খর¯্রােতা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণ কাজ শুরু করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অধীনে। পতেঙ্গা থেকে দক্ষিণ প্রান্তে আনোয়ারা পর্যন্ত টিউবের খনন কাজ শেষ হয় ২০২০ সালের ২ আগস্ট। একই বছরের ১২ ডিসেম্বর আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত টিউবের কাজ শুরু হয়ে পরবর্তী বছরের ৭ অক্টোবর তা শেষ হয়।
বাংলাদেশ সেতু বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত কর্ণফুলী টানেল শুধু বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ও একমাত্র আন্ডারওয়াটার টানেল। পুরো প্রকল্পে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ সুদে ঋণ সহায়তা দিেেয়ছে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। অবশিষ্ট ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা জোগান দিয়েছে সরকার। নদীর উপরিভাগ থেকে ৪২ দশমিক ৮০ মিটার এবং তলদেশ থেকে ৩১ মিটার গভীরে টানেলটি ৮ শতাংশ ঢালু করে নির্মাণ করা হয়েছে। ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলটির নদীর তলদেশের অংশের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩১৫ কিলোমিটার। এরমধ্যে টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ভিতরের ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার আর বাইরের ব্যাস ১১ দশমিক ৮০ মিটার, যা লম্বালম্বিভাবে ৪ দশমিক ৯০ মিটার। টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তের এপ্রোচ রোড ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার এবং ৭২৭ মিটার ওভারব্রিজ। টানেলের টিউব দূইটির ক্রস প্যাসেজ রাখা হয়েছে তিনটি। টানেলের গতিসীমা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার রাখা হলেও শুরুর দিকে ৬০ কিলোমিটার চলাচলের অনুমতি থাকার কথা জানান সড়[ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন।
তিনি বলেন, ‘টানেলের ইলেক্ট্রোমেকানিকেল কাজ শেষে হওয়ার পর প্রি-কমিশনিং ও কমিশনিং দেখা হয়েছে। এছাড়া সবগুলো সিস্টেম কাজ করছে কিনা কয়েকবার করে দেখা হয়েছে। কিছু নির্মাণ কাজ বাকি রয়েছে সার্ভিস এরিয়ায়, যা চলাচলে জন্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না। এপ্রোচ রোড, সার্ভিস এরিয়া, পুলিশের ফাঁড়ি নির্মাণ ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণের কার্যক্রম চলছে। কাজগুলোও দ্রুত সময়ে শেষ করা হবে।’
টানেলের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন. ‘টানেলের কনসেপ্টটা আমাদের কাছে নতুন। সেজন্য এটার কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। তবে এখানে একটি মজার বিষয় হচ্ছে, টানেলে ঢুকার আগে যেসব গাড়ি এফএম রেডিও চালু করবে সেগুলোতে টানেল ব্যবহারের নীতিমালা অটোমেটিক চলতে থাকবে। এফএম রেডিওর ছয়টি স্টেশন আছে। সবগুলোতেই এই নীতিমালা রয়েছে। টানেলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রেডিওতে এই নীতিমালাগুলো পড়ে শুনানো হবে। টানেল ব্যবহারে নিরাপত্তার স্বার্থে এই মূহুর্তে দুই বা তিন চাকার গাড়ি চলাচল নিরাপদ হবে না।’
টানেলের নির্মাণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক হারুন উর রশিদ বলেন, ‘দেশের অন্যতম খর¯্রােতা নদী কর্ণফুলী কিন্তু পুরো দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন। এই ছোট নদীর ওপর ইতোপূর্বে ৩টি সেতু করা হয়েছে। সেগুলোর অবস্থান অনেক বেশি উজানে হওয়ায়, সেখানে পানির গতিবেগ মোহনার থেকে কম। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য একটি সেতুর প্রয়োজন ছিল দীর্ঘদিন থেকেই। সবদিক বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী টানেল নির্মাণের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেন। এটি পুরো দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ও দীর্ঘতম টানেল। তাই নির্মাণকাজে আমরা সর্বোচ্চ আন্তরিকতা প্রয়োগ করেছি। তাই টানেলটি নিদিষ্ট সময়ে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় সংযুক্ত হচ্ছে।’
নিমার্ণকাজ ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘টানেলটির টিউবগুলো নদীর তলদেশের অনেক নিচে। নিরাপত্তা ও পাসিং সুবিধার কথা ভেবে তিনটি পাসওয়ে রাখা হয়েছে। দূর্ঘটনা ঘটলে সেটি মোকাবেলার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে উদ্ধারকর্মী প্রস্তুত থাকবে। এরপরও নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১০০টির বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। শুরুতে গতি সীমা কমিয়ে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার রাখা হয়েছে। মোটরসাইকেল বা তিনচাকার কোনো যানবাহন চলাচলের অনুমতি দেইনি। পাশাপাশি অতিরিক্ত ভারি যানবাহন যেন চলাচল করতে না পারে সেজন্য প্রবেশমুখে নির্মাণ করা হয়েছে ওজন স্কেল।
নিরাপত্তা নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আব্দুল হালিম বলেন, ‘টানেলে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলেও ৮০ মিটার পর পর রয়েছে জরুরি ভিত্তিতে বের হওয়ার ব্যবস্থা। এছাড়া টানেলের ভিতরে ৫০০ থেকে ৬০০ মিটারের মধ্যে তিনটি ক্রস প্যাসেজ করা হয়েছে। ক্রস প্যাসেজগুলো দিয়ে একটি থেকে আরেকটিতে দ্রুত চলে যাওয়া যাবে। সুতরাং দূর্ঘটনার কারণে কোনো ভোগান্তি বা টানেলের কোনো অসুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
টানেলের ইতিবাচক প্রভাব প্রসঙ্গে চিটাগং চেম্বার অব কর্মাস এন্ড ইন্ডস্ট্রির প্রেসিডেন্ট ওমর হাজ্জাজ বলেন, ‘টানেল শুরুর আগেই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো আনোয়ারায় বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে। কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শীতার ওপর সবার একটা বিশ্বাস তৈরি হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন যোগ হওয়া টানেলের কারণে শিল্প-কারখানাসহ আনোয়ারায় আরও বেশ বিনিয়োগ বাড়বে। পাশাপাশি মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর চালু হলে টানেলটির উপযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। যোগাযোগ খাতে সময় ও ব্যয় দুইটিই কমে আসবে। শিল্প-কারখানা ব্যবসা ছাড়াও ঢাকা-কক্সবাজার বা চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের পর্যটন এলাকাগুলো নিয়ে নতুন নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। তাই বলা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল জাতির শুধু গর্ব নয়, ভাগ্য উন্নয়নের একটি রাস্তাও।’
প্রসঙ্গত, দেশের বিভিন্ন সেতু এবং শাহ আমানত সেতুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বঙ্গবন্ধু টানেলের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্ধারিত টোল হলো- প্রাইভেট কার, জিপ ও পিকআপের জন্য ২০০ টাকা, মাইক্রোবাসের জন্য ২৫০ টাকা, ৩১ বা এর চেয়ে কম আসনের বাসের জন্য ৩০০ টাকা এবং ৩২ বা এর চেয়ে বেশি আসনের বাসের জন্য ৪০০ টাকা, ৫ টনের ট্রাকের জন্য ৪০০ টাকা, ৫ থেকে ৮ টনের ট্রাকের জন্য ৫০০ টাকা, ৮ থেকে ১১ টনের ট্রাকের জন্য ৬০০ টাকা, ট্রাক (তিন এক্সেল) ৮০০ টাকা, ট্রেইলর (চার এক্সেল) ১ হাজার টাকা এবং চার এক্সেলের বেশি হলে ট্রেইলরের ১ হাজার টাকার সঙ্গে প্রতি এক্সেলের জন্য ২০০ টাকা বাড়তি হবে।