সুপ্রভাত ডেস্ক রিপোর্ট »
দেশে ‘নিষিদ্ধ’ উচ্চফলনশীল জাতের ভেনামি চিংড়ির পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয়েছে এক বছর আগে খুলনার পাইকগাছায়।
অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর উচ্চ-উৎপাদনশীল ভেনামি চিংড়ির পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হচ্ছে চট্টগ্রাম অঞ্চলেও। মৎস্য অধিদপ্তর এই অঞ্চলের ৪টি চিংড়ি হ্যাচারিকে পরীক্ষামূলকভাবে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদনের অনুমতি দিয়েছে।
এসব প্রতিষ্ঠানকে এক বছরের মধ্যে পরীক্ষামূলক উৎপাদন কার্যক্রম শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- কক্সবাজারের উখিয়ার এম কে হ্যাচারি; কলাতলী এলাকার নিরিবিলি হ্যাচারি ও খুরুশকুল এলাকার মিডওয়ে সাইন্টফিক ফিসারিজ লিমিটেড ও চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে ডাফা ফিড অ্যান্ড অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেড।
ভেনামি চিংড়ি
যার বৈজ্ঞানিক নাম লিটোপেনিয়াস ভেনামি। পেনাইডি পরিবারের একটি উচ্চফলনশীল চিংড়ি। এটি প্রশান্ত সাগরের সাদা চিংড়ি, চিংড়ির রাজা ইত্যাদি নামেও পরিচিত। বাংলাদেশে এটি সাদা সোনা হিসেবে পরিচিত।
এ চিংড়ি সর্বোচ্চ ২৩ সে.মি. বা ৯.১ ইঞ্চি লম্বা হয়। অন্য সকল চিংড়ির চেয়ে এ চিংড়ির উৎপাদন বেশি। দেখা গেছে হেক্টর প্রতি এ চিংড়ির উৎপাদন সাত হাজার কেজির বেশি। যা বাগদার তুলনায় হেক্টর প্রতি প্রায় ছয় হাজার কেজি বেশি। তাই এ চিংড়ি চাষ বেশ লাভজনক।
ভেনামির ফলন পাওয়া যায় ৯০-১০০ দিনের মধ্যে। যেখানে বাগদা চিংড়ির ফলন পেতে হলে দরকার হয় ১৪০-১৬০ দিন। ভেনামি উচ্চফলনশীল বলে চায়না, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্ডিয়া, মিয়ানমারে ব্যাপকভাবে এটির চাষ হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করছে ভারত। অথচ বাংলাদেশ এখনো এর বাণিজ্যিক উৎপাদনই শুরু করতে পারেনি।
রপ্তানি কমছে
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ হিসাব বছরে বাংলাদেশ মোট ৪৫৫ মিলিয়ন ডলারের ৪১,২৩৬ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি করে। এরপর থেকেই বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে চিংড়ির বাজার হারাতে থাকে। সেই সাথে উৎপাদনও ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে চিংড়ি রপ্তানি ৩৪ শতাংশ কমে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হয়েছে ৩৬১ মিলিয়ন ডলার। সে বছরে ২৯ হাজার ৫৪৩ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি হয়েছিল।
২০১৯-২০ সালে আরও কমে চিংড়ি রপ্তানি দাঁড়ায় ৩৩২ মিলিয়নে এবং ২০২০-২১ বছরে গিয়ে আরও দুই মিলিয়নের রপ্তানি হারায়। তবে ২০২১-২২ এর প্রথম ছয় মাসে রপ্তানি হয়েছে ২৬৯ মিলিয়ন ডলার।
চিংড়ির আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। উদ্যোক্তারা দ্রুত ভেনামি চাষ সম্প্রসারণ করতে চাইলেও সরকারের তরফ থেকে আরোপিত নিয়ন্ত্রিত চাষ পদ্ধতি ভেনামির দ্রুত সম্প্রসারণকে বাধাগ্রস্ত করছে।
দ্রুত উচ্চফলনশীল ভেনামির বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে না পারলে আন্তর্জাতিক বাজারেও পিছিয়ে থাকবে বাংলাদেশ। এজন্য ভেনামি উৎপাদনের পাশাপাশি দ্রুত ভেনামির পোনা উৎপাদনেরও অনুমতি দেয়া দরকার।
যেভাবে যাত্রা শুরু
যশোর বিসিক শিল্পনগরের এম ইউ সি ফুডস ও সাতক্ষীরার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশীলন যৌথ উদ্যোগে খুলনার পাইকগাছা উপজেলায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০২১ সালের এপ্রিলে।
দেশীয় চিংড়ির উৎপাদন দিন দিন কমে আসছে। যে কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে হিমায়িত মৎস্য রপ্তানিতে সুবিধা করতে পারছে না বাংলাদেশ। তাই সরকার পরীক্ষামূলকভাবে উচ্চফলনশীল ভেনামি জাতের বিদেশি চিংড়ি চাষের অনুমতি দেয়, যেটি এত দিন ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কায় নিষিদ্ধ ছিল। বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) অধীনে পরীক্ষামূলকভাবে খুলনার পাইকগাছায় ভেনামি চিংড়ি চাষের প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়।
এম ইউ সি ফুডস ভেনামি চাষের জন্য থাইল্যান্ড থেকে ১০ লাখ ৮ হাজার পিস পোনা আমদানি করে। তাদের খুলনার পাইকগাছার চাষের পুকুর পর্যন্ত পৌঁছাতেই প্রায় ২৪ শতাংশ পোনা মরে যায়। আট লাখ পোনা ঠিকে থাকে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হলে এত বেশি পোনা নষ্ট হতো না বলে জানায় উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানটি।
ফলে উদ্যোক্তারা দাবি করেছেন, ভেনামির চাষ দ্রুত সম্প্রসারণের জন্য পোনা উৎপাদনের অনুমতি দেওয়ার। যেহেতু ধারাবাহিকভাবে পরীক্ষামূলক উৎপাদনের জন্য অনুমতি দেয়া হচ্ছে সেজন্য একইসঙ্গে হ্যাচারির মাধ্যমে পোনা উৎপাদনেও যাওয়া উচিত।
মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আট লাখ পোনা থেকে ১৬ মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদিত হবে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে ৬৫ থেকে ৭০ লাখ টাকায় বিক্রি হতে পারে। পোনা আমদানি, খাদ্য, শ্রমিকসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে এই চিংড়ি উৎপাদনে ৪০ লাখ টাকার মতো খরচ হবে। তার মানে, খরচ বাদে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা লাভ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাঁদের আশা, ভেনামি চিংড়ি চাষের মাধ্যমে দেশের মৎস্য খাতে বিপ্লব ঘটবে।
দেশীয় চিংড়ির উৎপাদন কমে যাওয়ায় ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমোদন পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস অ্যাসোসিয়েশন প্রায় ১২ বছর ধরে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেছে। অবশেষে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরকার পরীক্ষামূলকভাবে বিদেশি এই চিংড়ি চাষের অনুমতি দেয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে থাইল্যান্ড থেকে এই চিংড়ির পোনা আনতে কিছুটা দেরি হয়েছে। পোনা আনা হয়েছে বিমানে করে।
এক সময় হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি আয় এলেও এখন এই খাতটির অবস্থান সপ্তম। বর্তমানে বিশ্বের ৬২টি দেশে ভেনামি চিংড়ি বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে এশিয়ায় রয়েছে ১৫টি দেশ।
বিশ্বে চিংড়ি বাণিজ্যের ৭৭ শতাংশ দখল করে আছে ভেনামি চিংড়ি। বাগদা চিংড়ির তুলনায় দাম কম হওয়ায় বিশ্ববাজারে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং গ্লোবাল অ্যাকুয়াকালচার এলায়েন্সের তথ্য মতে, ২০১৮ সালে বিশ্বে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদিত হয়েছে সাড়ে ৩৫ লাখ মেট্রিক টন, বাগদা উৎপাদিত হয়েছে সাড়ে ৫ লাখ মেট্রিক টন, গলদা উৎপাদিত হয়েছে ২ দশমিক ৪ লাখ মেট্রিক টন। এ ছাড়া, অন্যান্য চিংড়ি উৎপাদিত হয়েছে ৩ লাখ মেট্রিক টন।
২০১৮ সালে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় ভেনামি চিংড়ি উৎপাদিত হয় ২৩ দশমিক ৯১ লাখ মেট্রিক টন। ২০১৯ সালে এই দেশগুলোয় উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৩১ দশমিক ১২ লাখ মেট্রিক টন। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান শূন্য।
শুধু বাগদা ও গলদা চিংড়ি রপ্তানি করে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় এখন আর টিকে থাকা যাবে না। সরকার ভেনামি চাষ উন্মুক্ত করে দিলে চিংড়ি রপ্তানি শিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়াবে।