দ্বীপ সরকার
ছেলের কথা শুনে হতভম্ব না হয়ে পারলেন না হযরত আলী। ‘আমাকে বিয়ে করান, আমার কি বয়স হয়নি? আপনাদের গোনাহ হচ্ছে না?’ অথচ ছেলে মেট্রিক পাসই করেনি। বয়স ১৩/ ১৪ হবে কোন মেয়েকে বিয়ে করবে, সেটাও বলে দিল অকপটে। কেমন নির্লজ্জ ছেলে আমার। হযরত আলী চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
সন্ধ্যায় হযরত আলী আর তার স্ত্রী নারগিস বানু ছেলেকে ডেকে উপদেশ দিতে লাগলেন। বাবা শোনো, অন্তত পড়াশোনাটা শেষ করো। তোমার পছন্দের মেয়েকে দিয়েই বিয়ে দেবো।
Ñনা, আমার অনেক আগেই বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। আমারও গোনাহ হচ্ছে, তোমাদেরও গোনাহ হচ্ছে। তোমরা ঘটক পাঠাও।
হযরত আলী, ওর স্ত্রী ছেলের এমন উদ্ভট কথা শুনে আবারও লজ্জিত হয়ে পড়লেন। হযরত আলী তার বড় জামাই, বড় মেয়েকে বিষয়টা শেয়ার করলেন। ওরাও ভাইকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তার একই বক্তব্য, একই রকমের কথা।
হযরত আলীর একটাই ছেলে মেহেদী। কেবল ক্লাস টেনে পড়ে। পাশের গ্রামের লোকমান আলীর মেয়ে মৌটুসীর সাথে সবে ভাব হয়েছে, তাতেই তার বিয়ে-বিয়ে বায়না। খুব করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে যখন আর পারলেন না তখন বিয়ের ব্যবস্থা করেই ফেললেন। তবে মেহেদীর কাছ থেকে কথা নিয়েছেন সে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে এবং বউকেও পড়াবে। পনেরো দিনের মাথায় মেহেদী-মৌটুসীর বিয়ে হয়ে গেল বেশ হইচই করে।
একদিন হযরত আলী শুক্রবারের জুমার নামাজ শেষে ইমামকে পাশে ডেকে নিয়ে ছেলের ওই কথাটা বলেন, ‘হুজুর আমার ছেলে তো বারবার বলছে সে বিয়ে করবে, ওর নাকি গোনাহ হচ্ছে, এমনকি আমাদেরও হচ্ছে, আসলে ঘটনা কি? হজুর বয়স জানতে চাইলে বললেন ১৩ বছর। হুজুর হেসে বলেন, ‘এরকম একটা শরীয়তি কথা আছে। বারো বছর থেকে ছেলেরা প্রজননক্ষমতা অর্জন করে। আপনার ছেলে এটাই বুঝেছে’। হযরত আলী ইমামকে বিদায় দিয়ে আস্তে-আস্তে পা টিপে বাড়ি ফিরছেন আর ভাবছেন, এটা কেমন যুগে এসেছি হায়! কতো মানুষ বিএ পড়ছে, মাস্টার্স পড়ছে, চাকরি করছেÑÑ তাদেরও তো বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। এই তো পাশের বাড়ির মফিজের ছেলে ইমরান। সে মাস্টার্স করলো, চাকরিও করছে। কিন্তু কই সে তো এমন উদ্ভট নয়।
মেহেদীর বিয়ের ছয় মাস হয়ে গেল। আস্তে-আস্তে ইস্কুল যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ওর বউটাও যায় না। একদিন এ নিয়ে বাবা-ছেলের হট্টগোল
বেধে গেল। পাড়ার ছেলেমেয়েরা এ নিয়ে ছি-ছি করে চলে গেল। ‘মাস্টার মানসের বেটা এ কি করলো’! গ্রামে হযরত আলী মাস্টারের একটা নামডাক আছে। কিন্তু ছেলে এ কি করলো। যে মেহেদী আগে বাপের কাজে কোনদিন হাত বাড়ায়নি সে কিনা এখন জমিতে যাওয়া শুরু করেছে। নেংটি মেরে জমিতে গরুর হাল বয়।
বছরখানেক পর মেহেদীর বন্ধু লালন ফোন দেয় ‘বন্ধু, কেমন আছো? আমি তো পরিবার নিয়ে তোমাদের গ্রামে এলহামের বাসায় এসেছি।’
Ñও তাই নাকি, তাহলে আমার এখানে আসো।
Ñওকে, আসছি বন্ধু।
কথা শেষ হতে না হতেই লালন তার পরিবার নিয়ে মেহেদীদের বাসায় আসে নিজেই মাইক্রো ড্রাইভ করে। সবেমাত্র মাইক্রো কিনেছে সে। তাই নতুন-পুরাতন বন্ধুদের বাসায় বেড়ানোর শখও বেড়ে গেছে। সাথে আছে ওর বউ আর ছেলে। বড় অফিসারেরা যে রকম ভাব-ভূমিকা নেয়, তারও ভাবভঙ্গি তেমন। বাইরে মাক্রোর হর্ন দিতেই মেহেদী দরজা খুলে স্বাগত জানায়। প্রায় আট-নয় বছর পর দেখা। কোলাকুলি সেরে মেহেদী ওদের দ্রুত ঘরে নিয়ে যায়। চেয়ার এগিয়ে দেয়। মেহেদী লালনের ছেলের গালে চুমু দিয়ে বলে, ‘লক্ষœীসোনা’। চুমু শেষ না হতে লালন বললো, বন্ধু বহুদিন দেখা নাই, কথা নাই। এখন কোথায়, কি করছো বলো? মেহেদী লজ্জা মেখে ভাঙা গলায় বললো, না মানে, ছোটখাটো একটা এনজিওতে আছি।
Ñও তা তো ভালোই করেছো। আমি তো এবার পিকেএসএফ’এর সহকারী পরিচালক হলাম। অনেকদিন দেয়-দেয় করেও প্রমোশন দেয় না। এবার দিয়ে দিল বেটারা। মেহেদী ধীরকণ্ঠে ‘ও তাই’ বলে নাশতাপাতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এর মধ্যে মেহেদীর বাপ হযরত আলী মাস্টার খোঁড়াতে-খোঁড়াতে এসে পাশের চেয়ারে বসলেন। লালন ওঠে দাঁড়িয়ে কদমবুচি করলো। কুশল জানতে চাইলে মাস্টার সাহেব চোখ মুছতে-মুছতে বলেন, ‘আমার একটাই ছেলে, বাবা। সখ ছিল ওকে বড় অফিসার বানাবো তোমার মতো। কিন্তু বিয়ে করে এখন জমিতে হাল বয়।’ তখন মেহেদী জগে পানি নিয়ে উপস্থিত হচ্ছিল। বাবার কথা শুনতে পায়। বাবার ওপর চটে ওঠে, ‘আমি হাল বই, সেটা কেউ শুনতে চেয়েছে তোমার থেকে, এ্যাঁ?’
লালন মেহেদীর আচরণে বিব্রতবোধ করে। বাবার সাথে এ কেমন আচরণ! আর এনজিওতে চাকরি করে এটাও তো মিথ্যাকথা। লালন ওঠে দাঁড়ায়। মেহেদীকে শুধু এটুকু বলল, ‘তোমার লাইফটা এমন হলো কেনো? তুমি এতো নিচে চলে গেছো জানলে, আসতামই না।’ মেহেদী লালনের কথায় মাথা নিচু করে থাকে। গোপনে চোখ মোছে।
মেহেদী লালনের চলে যাওয়া দেখে অপলক দৃষ্টিতে। নিজের জীবনের সাথে লালনকে মিলিয়ে দেখেÑ অনেক ফারাক। অনুশোচনা করতে থাকে। অল্পবয়সে বিয়ে করাটাই ভুল ছিল। ঘরে গিয়ে মেহেদী বউয়ের গালে চপটাঘাত করে বলে, ‘তু-ই আমার জীবননষ্টের মূল’।























































