সোমা মুৎসুদ্দী »
অদিতি যখন ছোট ছিলো, মনে পড়ে একবার প্রথম বেঞ্চে বসতে গিয়েও পারেনি। না তাকে বসতে না দেওয়া বন্ধুটা কোনও মেয়ে নয় ছেলে। তাকে পরের বেঞ্চেও বসতে দেয়া হয়নি। এভাবে পেছনে যেতে যেতে সে শেষের বেঞ্চে, বসেছিল। তখন থেকে পুরুষের প্রতি একটা অন্যরকম ভাবনা তাকে ঘিরে ধরেছিল। এভাবে আস্তে আস্তে ও বড় হতে লাগলো। নব্বইয়ের গণআন্দোলন তখন তীব্র। সে সবার কাছে শুনেছে দেশে গন্ডগোল লেগেছে কিন্তু কী গন্ডগোল সে বুঝতে পারেনি। অদিতি তার কাকার কাছে শুনছে রুদ্রের কবিতা, কী অসাধারণ আবৃত্তি করে। সাথে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার সেই ক্যাসেট, সৌমিত্রের কণ্ঠে কী অপূর্ব সেই টান ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’। অমিত আর লাবণ্যের সেই রসায়নে ডুবেছিল অদিতি, সাথে যোগমায়ার ছায়া তো আছে। অদিতি স্কুল থেকে ফিরে প্রতিদিন নিয়ম করে চলে যেতো জেঠুদের বাড়ি। সেখানে টেবিলের ওপর রাখা থাকতো আজকের সুর্যোদয় ম্যাগাজিন, ম্যাগাজিন খুলেই গেদু চাচার খোলা চিঠি অদিতি মন দিয়ে পড়তো। কী ভীষণ মজার রম্যচিঠি। তাছাড়া পুকুর পাড়ে বসে অদিতি জেঠুর মুখে দেশভাগের গল্প শুনতো। বিশ্বযুদ্ধের গল্প শুনতো। তখন থেকে সূর্যসেন, প্রীতিলতা, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী ও নেতাজির সাথে পরিচয়। জেঠু শোনাতেন কীভাবে আমাদের দেশের মুক্তিযোদ্ধদের পাশাপাশি আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল ও তাঁদের সাড়ে চার হাজার জওয়ানও আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে মৃত্যবরণ করে।
অদিতি যখন দোকান থেকে কিছু কিনে আনতো, সেই জিনিসটা মুড়িয়ে দেওয়া হতো কাগজের টুকরো দিয়ে। কখনো আনন্দবাজার পত্রিকা, কখনো দেশ পত্রিকা, কখনোবা আজাদী। টুকরোগুলো সে রেখে দিেেতা, টুকরোর গায়ে লেগে আছে অসাধারণ সব কবিতা, আর ঠিক তখন থেকে তার মধ্যে লেখিকা হওয়ার ইচ্ছেটা বেশ পেয়ে বসে। তাছাড়া যেখানেই কোনও ভালো বই পেতো সে অনায়াসে পড়ে ফেলতো। হোক সুকুমায় রায়, সুকুমার বড়ুয়ার ছড়া। একবার তাদের গ্রামের সংগঠনের একটি ম্যাগাজিনে প্রথম ছড়ার মতো কিছু একটা লিখেছিল। বোকা দাদু। নতুন হাতের আঁকিবুঁকিভরা অদিতি ওটাকে ছড়া বলতে রাজি নয়। জেঠু অদিতিকে বলতো কীভাবে হানাদাররা আসলে সবাই ওদের গ্রামের পূর্বদিকের পাহাড়ে চলে যেতো। অদিতি দেখেছে গ্রামের কাঁচা রাস্তা, হারিকেনের আলোয় পড়ার অভিজ্ঞতা, সেই সাথে বাড়িতে বিদ্যুৎ আসার সেই প্রথম অনুভূতি। বছরে দুটো জামা পাওয়ার আনন্দে চোখে-মুখে উচ্ছলতা। মাঠে খেলতে যাওয়া সেই বিকেল। সবকিছুই অদিতির মনে ছায়া ফেলেছে। মনে আছে বিটিভির সেই স্বর্ণালি দিন। মাসে একটা সিনেমা দেখার জন্য সবার কী আগ্রহ। সেই সাথে অদিতিকে লেখার জন্য যিনি আড়ালে উৎসাহ দিয়েছেন, অদিতির ভাষায় তিনি সমরেশ মজুমদার। ছোটবেলা থেকে পাহাড়ের প্রতি এক অদ্ভুত মায়া অদিতির। পাশাপাশি আশেপাশে লোকদের নানা কুটনামিও সে দেখেছে আর ভেবেছে মানুষ কেনো মানুষের ভালো চায় না। অদিতির লেখার জীবনের সাথে যুক্ত হলো আবৃত্তিচর্চাও। সব মিলিয়ে দিনগুলো কী অসাধারণ কেটেছে অদিতির। ওর ক্ষুদ্র জীবনে ও শুনেছে কীভাবে ওর পূর্বপুরুষেরা মন্দির আর অনাথ আশ্রমের জন্য জায়গা দান করে গেছে। ব্রিটিশের কাছ থেকে কীভাবে ওদের পদবি এসেছিল। এখানেও একটা শ্রেণি কীভাবে ওদের পূর্বপুরষকে দালাল আর ব্রিটিশের সহযোগী আখ্যা দিয়েছিল। ওদের পূর্বপুরুষেরা ব্রিটিশের অধীনে খাজনা আদায় করতো।
পরবর্তী সময়ে তারাই চট্টগ্রামের ভূমি অফিসগুলোতে উচ্চপদে বহাল ছিল আর ব্রিটিশের আনুগত্য লাভ করায় ওরাও একসময় জমিদারি শুরু করে। সবকিছু মিলিয়ে পরিবেশ, পরিস্থিতি অদিতিকে লেখার জগতে নিয়ে এসেছে।